সত্যিই বাজে কথা বলছি না। অন্তত আপনাকে নিশ্চয়ই বাজে কথা বলব না।
আমি তো তাই আশা করি।
দাদা মারা গিয়েছেন জানেন তো?
উনি তো ব্যাঙ্গালোরেই মারা যান?
হ্যাঁ।
সব কাগজেই তো সে খবর ছাপা হয়েছিল।
আমার শাশুড়িও মারা গিয়েছেন…
তাই নাকি?
হ্যাঁ। ইন ফ্যাকট দাদা মারা যাবার ঠিক মাস খানেক আগেই উনি মারা যান!
কি হয়েছিল জয়ন্তী বৌদির?
ক্যান্সার। ধরা পড়ল একেবারে লাস্ট স্টেজে।
বৌদির মৃত্যুর খবরটা শুনেই মন খারাপ হয়ে গেল। মনে পড়ল ওয়াশিংটনের কথা, কায়োর কথা। আরো কত কি! বড় ভালোবাসতেন আমাকে।
পৃথিবীর সব মানুষ ভালোবাসা চায়, কিন্তু খুব কম, মুষ্টিমেয় মানুষই ভালোবাসতে পারে। মানুষের সব চাইতে বড় সম্পদ প্রেম ভালোবাসা। সেই প্রেম, সেই ভালোবাসা, মনের সব চাইতে বড় ঐশ্বর্য অপরিচিত মানুষকে তো দূরের কথা নিজের প্রিয়জনদেরও সবাই বিলিয়ে দিতে পারি না আমরা। বৌদি পারতেন। অনায়াসে পারতেন। মানুষকে ভালোবাসতে জয়ন্তী বৌদির কার্পণ্য ছিল না। আমেরিকা থেকে চলে আসার দিন নিউইয়র্ক এয়ারপোর্টে ওঁকে বললাম, লোকে এখানে। এসে কত কি জিনিস সওদা করে, কিন্তু আমার মতো বিনা পয়সায় এমন সওদা করে নিয়ে যেতে পারে কজন?
কি আবার সওদা করলে? কিছুই তো কিনলে না।
আপনাদের ভালোবাসার যে সওদা করে নিয়ে যাচ্ছি তার চাইতে…
ভালোবাসতে জানলে ভালোবাসা পাওয়া যায় ভাই। তুমি ভালো না বাসলে কি আমরা ভালোবাসতাম?
আমি তর্ক করলাম না। সময় ছিল না, কিন্তু আসলে উনি ঠিক উল্টো কথাটাই বললেন। ভাদ্দরের অন্ধকার আকাশে সামান্য একটু বিদ্যুৎ চমকের মতো তর্জন গর্জন, কিন্তু কতটুকু তার আলো? কতক্ষণই বা তার মেয়াদ। আর সূর্য? অমাবস্যার সূচীভেদ্য অন্ধকার ভেদ করে সে মহাতপস্বী সাধকের মতো মাথা তুলে দাঁড়ায়, পৃথিবীর দশ দিকে নিজের সবটুকু আলো ছড়িয়ে দেয়, কিন্তু তার কোনো তর্জন-গর্জন নেই। সুভাষদা আর জয়ন্তী বৌদি ভালোবাসার মাধুর্য আপন চারিত্রিক মহিমায় আমাকে বিলিয়ে দিয়েছেন।
কায়রো থেকে আসার আগে বৌদির কাছে একটা ফটো চাইলাম।
আমার ছবি নিয়ে কি করবে ভাই?
কি আর করব? আমার কাছে থাকবে। মাঝে মাঝে দেখব, কথা বলব।
আমার আলাদা ছবি রাখতে হবে না। ছবি দেখে জোর করে আমাকে মনে করতে হবে না। যদি এমনি আমাকে মনে রাখতে না পার, তাহলে মনে রেখো না।
অনেকবার অনুরোধ করলাম, কিন্তু কিছুতেই উনি ওঁর একটা ছবি দিলেন না। সেদিন ঠিক খুশী হইনি। পরে বুঝেছিলাম সত্যি ওঁর ফটো রাখার দরকার নেই, ওঁর সান্নিধ্য যারা পেয়েছে তাদের কাছে ওঁর স্মৃতি অম্লান রইবেই।
বড় অপরাধী মনে হলো নিজেকে। ওঁরা কলকাতা চলে যাবার পর কতবার কলকাতা গেছি, কিন্তু একবারও দেখা করিনি। সাহস হয়নি। ভয় করেছে যদি কথায় কথায় বেরিয়ে যায় রমা আমাকে…
পারিনি। কিছুতেই পারিনি। প্রত্যেকবার ফেরার পথে মনে হয়েছে অন্তত একবার কয়েক মিনিটের জন্য অবশ্যই যাওয়া উচিত ছিল। ভীষণ অন্যায় হয়েছে। এর পরের বার কলকাতায় গিয়ে নিশ্চয়ই দেখা করব। পরের বার গিয়েও পারিনি। হেরে গেছি।
বৌদি মারা গেলেন আর সুভাষদা আমাকে একটা খবর দিলেন না? নিজেই যেন নিজেকে প্রশ্ন করলাম।
দেবব্রত বললো, উনি এত বেশি আঘাত পেয়েছেন যে, চিঠিপত্র লেখা তো দুরের কথা, কারুর সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তাও বলেন না।
আমি চুপ করে বসে রইলাম। একটা কথা বলতেও মন চাইল না। সুভাষদা আর বৌদির চিন্তায় তলিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ ওর কথায় চমক ভাঙল, রঞ্জনার ছেলে হয়েছে, জানেন তো?
কই না তো!
এই তো একটু আগেই বললাম স্ত্রী-পুত্র ঘর বাড়ি ছেড়ে এসেছি, শোনেননি?
স্ত্রীকে ছেড়ে এসেছে শুনেই মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। ইন এনি কেস, কনগ্রাচুলেশনস।
আমাকে নয়, রঞ্জনাকে কনগ্রাচুলেট করবেন।
ওর সঙ্গে দেখা হলে ওকে কনগ্রাচুলেট করব। এখন তো আপনাকেই করি। ইউ আর দ্য প্রাউড ফাদার…
দেবব্রতর সুন্দর মখখানা যেন হঠাৎ শুকিয়ে পাংশু বর্ণ হয়ে গেল মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, আই অ্যাম নট…
আমার পিঠের উপর যেন একটা চাবুকের বাড়ি পড়ল। হুইস্কির গেলাসটা খুব জোরে সেন্টার টেবিলে রেখে প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, হোয়াট?
ধীর, স্থির, শান্ত দেবব্রত আবার মাথা নাড়তে নাড়তে বললে, আমি ঐ ছেলের বাবা না।
টেবিল চাপড়ে আমি পাগলের মতো চিৎকার করে বললাম, স্টপ টকিং ননসেন্স।
আমার চিৎকারে দেবব্রত একটু থতমত খেয়ে মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ আমি ওর মুখের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারলাম না। বেশিক্ষণ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। দৃষ্টিটা আবার ঘুরিয়ে আনতেই দেখি দেবব্রতর দুটো চোখ জলে ভরে গেছে। বিশ্বাস করুন দাদা, আপনাকে আমি মিথ্যে কথা বলছি না, ভগবানের নামে মা কালীর নামে শপথ করে বলছি ও ছেলে আমার নয়।
কিন্তু দেবুবাবু, রঞ্জনা তো এমন কাজ করতে পারে না। আমি তা ওকে খুব ভালোভাবে চিনি।
আমি জানি রঞ্জনা ভালো। রঞ্জনা আমাকে ভালোবাসে। তবে একথাও জানি ও ছেলের জন্মদাতা আমি না।
আমি স্বীকার করতে পারলাম না, এ হতে পারে না, এ অসম্ভব।
এই পৃথিবীতে কিছুই অসম্ভব নয়।
তা ঠিক! তবুও…
আমার দাদা ডক্টর দেবতোষ চৌধুরীই ঐ ছেলের…
আঃ। দেবুবাবু। আপনি কি উন্মাদ হয়েছেন?