না, না, ও কিছুই করেনি।
.
সুভাষদা আর বৌদি দশদিন দিল্লি ছিলেন। একদিন ডক্টর চৌধুরী আমাকে নেমন্তন্নও করেছিলেন। পাছে ওঁরা আমাকে সন্দেহ করেন, একদিনের জন্য আগ্রা চলে গিয়েছি। আমি রঞ্জনাকে বিরক্ত করিনি।
০৭. সেন্ট্রাল লাইনের টিউবে চড়তে
সেন্ট্রাল লাইনের টিউবে চড়তে না চড়তেই অক্সফোর্ড সার্কাসে নেমে পড়লাম। দু মিনিটের মধ্যেই বেকারলু লাইনের গাড়ি এলো। ভীষণ ভিড় তবু উঠে পড়লাম। কিছু দেখতে না পেলেও গাড়ি থামতেই বুঝলাম পিকাডিলি সার্কাস। তারপর ট্রাফালগার স্কোয়ার। চারিং ক্ৰশ। নেমে পড়লাম। স্ট্রান্ড দিয়ে হাঁটছি। কত দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মানুষ আমার এপাশ-ওপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। কত সুন্দরী। কত হট প্যান্ট। কিছু দেখতে পেলাম না। চোখের সামনে শুধু রঞ্জনার ছবিটাই ভেসে উঠলো।
সারাদিন খুব ঘুরেছি। হোটেলে এসেই হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম। ঘুম ভাঙল টেলিফোনের ঘণ্টায়। রিসেপসনের টোলিফোন, স্যার মিঃ চাউডারী ইজ হিয়ার।
আমার ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলেই উঠলাম। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরেই দেবু এলো। আসুন আসুন।
দেবু আমার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, আপনাকে বোধহয় ডিসটার্ব করলাম, তাই না?
ডিসটার্ব করবেন কেন? আমিই তো আপনাকে আসতে বলেছি।
দেবু বলল। আপনার দরজায় কয়েকবার নক করে কোনো রেসপন্স না পেয়ে রিসেপসন থেকে টেলিফোন করলাম।
সারাদিন ঘুরাঘুরি করে এত টায়ার্ড হয়েছিলাম যে ঘরে ঢুকেই শুয়ে পড়েছিলাম।
দেবু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল, তাহলে বরং আপনি রেস্ট নিন, আমি কাল আসব।
আমি দেবুর কাঁধে হাত দিয়ে বসিয়ে দিলাম, বসুন বসুন। হাতের ঘড়িটা দেখে বললাম, প্রায় দু ঘণ্টা ঘুমিয়েছি। আর রেস্ট নেবার দরকার নেই।
জুতার ফিরে খুলতে খুলতে বললাম, ঠিক পনেরো বছর আগে আপনার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। মনে আছে?
নিশ্চয়ই।
সেকেন্ড টাইম যখন লন্ডনে এলাম তখন আপনার ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে…।
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ও বললো, আমরা দুজনে ডুরি লেন থিয়েটারে মাই ফেয়ার লেডী দেখেছিলাম…
লীডস যাওয়ার কথা মনে আছে?
সেই ডক্টর ঘোষের নতুন অস্টিনে চড়ে গিয়েছিলাম। মনে থাকবে না?
আর ওয়াই-এম-সি-এতে একদল আলজেরিয়ান ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে…
হাসতে হাসতে দেবব্রত বললো, সত্যি অমন পাগলের মতো সারারাত ডান্স কোনদিন করিনি।
তবে ছেলেগুলো সত্যি খুব ভদ্র ছিল।
নো ডাউট অ্যাবাউট দ্যাট। তবে মোস্ট ইন্টারেস্টিং ছিল সেই রোমান্টিক ফ্রেঞ্চ ফটোগ্রাফার ছেলেটি।
দ্যাটস্ রাইট! তাহলে দেখছি আপনার সব কিছু মনে আছে।
সব কিছুই যে মনে থাকে সেইটাই তো বিপদ।
বিপদ কেন?
দেবু একটু শুকনো হাসি হাসল, সব কিছু ভুলে গেলেই ভালো হতো।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, কি ব্যাপার? মানের মধ্যে কিছু অভিমান জমা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে?
আপনি জামা কাপড় চেঞ্জ করে নিন। তারপর কথা হবে।
জামাকাপড় পাল্টে একটু বাথরুম থেকে ঘুরে এসেই দেবুর সামনের সোফায় বসলাম। প্রস্তাব করলাম, সুড উই হ্যাভ সাম হুইস্কি?
দেবু সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা হোয়াইট হর্সের বোতল আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, উইথ কাইন্ডেস্ট রিগার্ডস!
আমি একটু বিস্মিত হয়ে বললাম, একি। আপনি আনলেন কেন?
ক্ষতি কি? এখন তো আমি ছাত্র নেই, চাকুরি করছি!
তাহলেও আপনার আনা ঠিক হয়নি।
কেন?
আমি আপনাকে আসতে বলেছি, খেতে বলেছি, সো ইট ইজ মাই ডিউটি টু এন্টারটেন ইউ।
আমার সঙ্গে ফর্মালিটি করার দরকার নেই। এর আগে যতবার আপনার এখানে এসেছি প্রত্যেকবারই আপনি আমাকে যথেষ্ট এন্টারটেন করেছেন। এবার না করলেও অন্যায় হবে না।
হবে না?
অফ কোর্স নট!
শেষ পর্যন্ত বোতল খুলে দুটো গেলাসে ঢেলে শুরু হলো, চিয়ার্স।
চিয়ার্স।
শুরু হলো কথাবার্তাও। হুইস্কির গেলাসটা নামিয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি এখানে চাকরি নিলেন কবে।
দু বছর হয়ে গেল।
হঠাৎ ব্যাঙ্গাললারের চাকরি ছাড়লেন? ওখানে তো ভালোই ছিলেন।
শুধু ব্যাঙ্গালোরের চাকরি নয়, সব কিছুই ছেড়ে দিলাম।
তার মানে? গেলাসে চুমুক দিতে গিয়েও নামিয়ে নিলাম।
তার মানে সত্যিই সব কিছু ছেড়ে এসেছি। আই মীন স্ত্রী-পুত্র, ঘর বাড়ি দেশ–সব কিছু।
কি আজেবাজে কথা বলছেন? একটু শাসন করার সুরেই বললাম।
এখন তো হাফ পেগ হুইস্কিও পেটে যায়নি। আজেবাজে কথা বলার সুযোগ পেলাম কোথায়? তাছাড়া এখন এই পুরো বোতল হুইস্কি খেলেও আমি মাতাল হবে না।
আপনি কি আজকাল খুব ড্রিঙ্ক করেন?
খুব করি কিনা জানি না, তবে তিনশ পঁয়ষট্টি দিন ড্রিঙ্ক করি।
এত ড্রিঙ্ক করে টাকা পয়সা নষ্ট করছেন কেন? রোজ ড্রিঙ্ক করবেন না।
মানি ইজ নো প্রবলেম…
কেন?
একটু লেখাপড়া শিখেছি বলে বেশ ভালোই রোজগার করি। এর সিকি ভাগ আয় করে লোকে সংসার চালিয়েও বাড়ি-গাড়ি করছে।
আপনি গাড়ি কেনেননি?
আমার গেলাসের অর্ধেকও শেষ হয়নি, কিন্তু এরই মধ্যে ওর ড্রিঙ্ক শেষ। নিজেই আবার গেলাস ভরে নিলো। তারপর এক চুমুক দিয়ে বললো, ওসব ঝামেলায় আমি আর নেই। একবার স্ত্রী-পুত্রকে যখন চিরকালের মতো ছাড়তে পেরেছি তখন…
কথাগুলো শুনতে ভারি খারাপ লাগল। বললাম, আবার আজেবাজে কথা বলছেন।