আমি বললাম, উনি কদিনের জন্য বেড়াতে এসেও সংসারের ঝামেলা সহ্য করবেন? আমাকে যদি দায়িত্ব দিতে না চাও তাহলে তুমি তো নিতে পারতে।
ও স্পষ্ট বললো, আমি টেম্পোরারী দায়িত্ব নিই না।
আমি আর সুভাষদা বসে বসে শুধু পলিটিক্স আলোচনা করেছি, চা-কফি খেয়েছি, সিগারেই টেনেছি। মাঝে মাঝে কিচেনের কাছে গিয়ে বলেছি, ইফ দেয়ার ইজ এনি ডিফিকাল্টি লেট মী মো।
টিপ্পনী কাটার সুযোগ রমা ছাড়ে না, আমার উপর মাতব্বরী করেন বলে কি মার উপরেও মাতব্বরী করবেন?
তোমার উপর আমি মাতব্বরী করব? এত সাহস আমার নেই!
জয়ন্তী বৌদি হাসেন।
সুভাষদা একা ঘরে বসে থাকতে পারেন না। হেলতে দুলতে কিচেনের সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, বাজার-টাজার যেতে হবে নাকি?
জয়ন্তী বৌদি হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন কি দায়িত্বশীল লোক দেখেছ! পৌনে বারোটার সময় বাজার যাবেন কিনা জিজ্ঞাসা করছেন।
আমি বললাম, বৌদি, একে বলে সেকেন্ড লাইন অব ডিফেন্স। বাই চান্স যদি আপনি কিছু ভুলে যান…
তুমি, চুপ করো তো। তোমাকে আর ওর মোসাহেবী করতে হবে না!
সারপ্রাইজিং! সবাই বলে আমি আপনার আর রমার মোসাহেবী করি।
রমা রেগে যায়, এইসব বাজে কথা বললে কিন্তু ভালো হবে না।
যে কথাই বলি না কেন, তুমি আমার ভালো করবে না। সুতরাং ও ভয়ে কম্পিত নয় জার্নালিস্টের হৃদয়!
সুভাষদা হাসতে হাসতে ড্রইংরুমে চলে গেলেন। বৌদিও রান্নায় মন দিলেন। রমা বললো, জার্নালিস্টদের হৃদয় থাকে নাকি?
একবার সুভাষদা ফরেন সেক্রেটারির সঙ্গে জরুরি পরামর্শের জন্য কায়রো থেকে কয়েক দিনের জন্য দিল্লি এলেন। রমা তখন বেনারসে, কিন্তু কিছুতেই সুভাষদার পক্ষে বেনারস যাওয়া সম্ভব ছিল না। অথচ কায়রো থেকে দিল্লি এসেও মেয়ের সঙ্গে দেখা হবে না, তাও হয় না। আমার কাছে সুভাষদার টেলিগ্রাম এলো, রিচিং মনডে আর্লি মর্নিং ফর আর্জেন্ট কনশালটেশন। রমা রিচিং সানডে অর মনডে বাই এয়ার। সুভাষদার টেলিগ্রাম এলো শুক্রবার সকালে। শনিবার দুপুরে অফিস বেরুবার সময় রমার টেলিগ্রাম এলো, রিচিং মনডে ভায়া লখনৌ অ্যাটেন্ড পালাম।
সুভাষদা আর রমা পাঁচদিন আমার কাছেই ছিলেন। তিনজনে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট খাবার পর সাড়ে নটায় সুভাষদা সাউথ ব্লক যেতেন। একটা দেড়টা-দুটোয় লাঞ্চে এসে আবার তিনটের মধ্যে ফিরে যেতেন। তারপর ফিরতে ফিরতে সাড়ে ছটা-সাতটা হয়ে যেতো। রোজ রাত্রে আমরা তিনজনে বাইরে খেতাম। একদিন নাইট শোতে সিনেমাও দেখেছিলাম। তারপর একই দিনে ওঁরা দুজনে পালাম থেকে চলে গেলেন।
ওই একবারই রমা আমার বাড়িতে থেকেছে। রাধাকিষণ সংসার চালাতো। আমি অফিসে গিয়ে বুড়ি ছুঁয়েই চলে এসেছি। থাকলেও এক ঘণ্টার বেশি কোনদিন থাকিনি। বাকি সময় বাড়িতে বসে বসে রমার সঙ্গে গল্প করেছি, আড্ডা দিয়েছি।
আমরা এসে আপনার কাজের খুব ক্ষতি করছি, তাই না? খবরের কাগজ পড়তে পড়তে নামিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল।
জীবনে কিছু ক্ষতি স্বীকার না করলে তো লাভও করা যায় না।
এ ক্ষতির বিনিময়ে কি আর লাভ করছেন?
আমি সিগারেট ধরিয়েই বললাম, এভাবে তোমার সঙ্গে আড্ডা দিতে পারছি, এটাই কি কম লাভ?
আমাকে খুশী করার জন্য এসব কথা বলে কি লাভ?
তোমাকে খুশী করার জন্য তো বলছি না। বলছি আমার মনের কথা।
রমা আবার একটু হাসল, বললো, যাই বলুন, আপনার কথা ভাবলে আমার অবাক লাগে।
কেন?
হঠাৎ কিভাবে আলাপ হলো, ঘনিষ্ঠতা হলো ভাবলে অবাক লাগে।
আমিও মাঝে মাঝে এই একই কথা ভাবি। কত ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গেই তো আলাপ, কিন্তু কেউ কি তাদের এমন সুন্দরী মেয়েকে আমার হেপাজতে রাখবে?
কেউ বুঝি আপনাকে বিশ্বাস করেন না?
তুমিও দেখছি ডিপ্লোম্যাটদের মতো কথা ঘোরাতে ওস্তাদ হয়েছ।
.
সেই আমি রমাকে আসতে বললাম না। বলতে পারলাম না। শুধু সুভাষদা আর বৌদিই এলেন। রাধাকিষণ অনেক কিছু রান্না করেছিল। অনেক গল্পগুজব করলাম ওঁদের দুজনের সঙ্গে, কিন্তু কিছুতেই সেই আগের মতো আনন্দ পেলাম না। হলো না। অনেক সহজ সরল করে মেলামেশা করলেও মনে মনে সব সময় একটু অস্বক্তিবোধ না করে পারলাম না। বিকেলের দিকে যাবার সময় সুভাষদা শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা না করে আর পারলেন না, ডক্টর চৌধুরী বা দেবু বা রমা কি তোমার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করেছেন?
আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলাম, না না, ওঁরা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবেন কেন?
তাহলে তুমি কি কোনো ব্যাপারে দুঃখ পেয়েছ?
সে রকম কিছু তো ঘটেনি।
যাই বল ভাই কিছু একটা ঘটেছে।
কিছুই ঘটেনি। তবে আপনাদের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠতা আছে তা তো ওঁদের সঙ্গে হতে পারে না, হবে না।
দ্যাটস্ ট্রু বাট…
ডক্টর চৌধুরী ইজ রেয়েলি সামবডি অব ডেলহি। আমার মতো জার্নালিস্টের পক্ষে ওখানে খুব বেশি যাতায়াত করা ঠিক নয়। তাছাড়া আমার এক কলিগ চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় আমার উপর ভীষণ কাজের চাপ পড়েছে। সত্য কথাটা চাপার জন্য গড় গড় করে অনেক কথা বললাম।
বৌদি চুপ করে আমাদের কথা শুনলেন, একটি কথাও বললেন না। ট্যাক্সিতে চড়বার আগে শুধু বললেন, রমা যদি কোনো অন্যায় করে থাকে তাহলে ক্ষমা করে দিও।
না, না, বৌদি, রমা কিছু অন্যায় করেনি।
করা উচিত নয়, কিন্তু করতেও তো পারে। ভুল করেও মানুষ অন্যায় করে।