টেলিফোনেই সুভাষদাকে বললাম, এয়ারপোর্টে যেতে পারলাম না বলে নিশ্চয়ই রাগ করেছেন?
রাগ করব কেন? তবে আশা করেছিলাম তুমি থাকবেই।
নিশ্চয়ই আশা করবেন। আপনারা আমাকে এতো ভালোবাসেন আর এইটুকু আশা করবেন না?
একবার ভাবলাম হয়তো চিঠি পাওনি, কিন্তু যাদের চিঠি দিয়েছিলাম তাদের মধ্যে শুধু তোমাকেই দেখতে না পেয়ে মনে হলো চিঠি ঠিকই পেয়েছ।
ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে চিঠি পাঠিয়েছেন। না পাবার তো কোনো কারণ নেই।
তোমার বৌদি অবশ্য বলছিলেন নিশ্চয়ই কোনো জরুরি কাজে আটকে গিয়েছে।
বৌদির ফিফথ সেন্স রিয়েলি খুব স্ট্রং।
তা ঠিক। আমি অনেকবার তার প্রমাণ পেয়েছি।
আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলাম, বৌদি পাশে আছেন?
না।
আপনার কথাগুলো বৌদি শুনলে খুব খুশী হতেন।
কথাগুলো শুনলে বলতো, আমি ওকে শোনাবার জন্যই প্রশংসা করছি।
বৌদি কি কোনো কাজ করছেন?
কাজ আবার কি করবে? নিশ্চয়ই ভিতরের ঘরে বসে রমার সঙ্গে গল্প করছে।
দেবু এখানে আছে নাকি?
না, ও তো এখানে নেই। গৃহপ্রবেশের পর পরই ব্যাঙ্গালোরে চলে গেছে।
তাই নাকি? ও চলে গেছে, তুমি জানতে না?
না।
সুভাষদা একটু বিস্ময়ের সঙ্গেই জিজ্ঞাসা করলেন, দেবু যাবার আগে তোমার সঙ্গে দেখা করেনি?
না। বোধহয় সময় পায়নি।
সময় পায়নি একটা কোনো কথাই নয়। এখান থেকে তোমার ওখানে ঘুরে আসতে কতক্ষণ আর সময় লাগে?
নিশ্চয়ই এমন কোনো কাজে জড়িয়ে পড়েছিল যে…।
এই কথার পুনরাবৃত্তি করছিলাম বলে সুভাষদা প্রশ্ন করলেন, তুমি এর মধ্যে ওদের এখানে এসেছিলে নাকি?
না দাদা, আমিও আর যেয়ে উঠতে পারিনি।
সুভাষদা ডিপ্লোম্যাট। কূটনীতিবিদ। বেশি কথা না বললেও অনেক কথা বুঝতে পারেন। অনুমান করতে পারেন। তাই বোধহয় ঐ বিষয়ে আর কিছু জানতে চাইলেন না। জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার। বৌদির সঙ্গে কথা বলবে?
নিশ্চয়ই।
একটু ধরো, ডেকে দিচ্ছি।
একটু পরেই বৌদি টেলিফোন তুলে নিলেন। অনেক কাল পরে টেলিফোনে বৌদির গলা শুনেই চমকে উঠলাম। ঠিক রমার মতো শোনাল। বললেন, তোমার দাদার কাছে শুনলাম কাজে আটকে পড়েছিলে বলে এয়ারপোর্টে আসতে পারনি।
এমন কাজের চাপ পড়েছে যে কি বলব?
শুনলাম এই নতুন বাড়িও তুমি দেখতে আসনি।
আমার এক কলিগ চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় একা আমার উপর সব কাজের চাপ পড়েছে…
আমি তোমার দাদাকেও ঠিক এই কথাই বলছিলাম…
যাই হোক টেলিফোনেই একটা অনুরোধ করব। রাখবেন তো?
তোমার অনুরোধ রাখব না? বল কি ব্যাপার।
কাল আপনারা দুজনে আমার এখানে খাবেন।
কখন?
দিনে অথবা রাত্রে। যখন আপনাদের সুবিধে।
আমাদের আবার অসুবিধে কি? দুপুর বেলাতেই আসব।
খুব ভালো।
.
ওঁরা যখনই দিল্লি এসেছেন তখনই দুএক বেলা আমার বাসায় থেকেছে, খেয়েছে। তবে শুধু ওঁরা দুজনে কখনই আসেননি। এসেছে দেবুকে নিয়ে, রমাকে নিয়ে। দেবু দিল্লিতে না থাকলে রমাকে নিয়েই এসেছেন। কি দারুণ আনন্দে যে সময়টা কেটে যেতে তা ভাবলে অবাক লাগে। একবার সুভাষদা আগের দিন রাত্রেই আমার এখানে চলে এলেন। এসেই বললেন, রাত্রেই তোমার এখানে চলে এলাম।
খুব খুশী হয়েই বললাম, খুব ভালো করেছেন, কিন্তু বৌদি কোথায়?
তোমার বৌদি বা রমা আসেনি। আমি একলাই চলে এলাম।
ওঁদের নিয়ে এলেন না কেন?
ওরা এলে কি আমরা ঘুমুতে পারতাম? ঘুমুবার জন্যই তো তোমার এখানে চলে এলাম।
ওরা সকালেই আসবে তো?
কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।
তার মানে? অন্য কোন প্রোগ্রাম আছে নাকি?
প্রোগ্রাম আবার কি থাকবে?…
তাহলে আসার ঠিক নেই মানে?
একবার শুনছিলাম ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠেই চলে আসবে। তারপর একবার শুনলাম লাইক রিয়েল গেস্টস ঠিক একটায় আসবে…
আমি হাসতে হাসতে বললাম, একটার সময় এলে আমি বাড়িতে ঢুকতে দেব নাকি?
ওদের ঢুকতে দেবে কি না দেবে, সে তুমিই জান, আমাকে তো বিরক্ত করবে না?
সুভাষদা আমার ঘরে ঘুমুচ্ছেন। আমি আমার স্টাডিতে ডিভানের উপর চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছি। হঠাৎ কানের কাছে খুব মিহি মিষ্টি ডাক শুনলাম, উঠবেন না? চা নিয়ে এসেছি।
দুতিনবার। ঘুম ভেঙে গেলেও ঘোর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। ভাবলাম বোধহয় স্বপ্ন দেখছি।
উঠুন। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে।
চাদর সরিয়ে দেখি রমা। তুমি?
হ্যাঁ আমি।
কখন এলে?
অনেকক্ষণ।
বৌদি কোথায়?
বাথরুমে।
তুমি চা নিয়ে এলে যে?
ঘুম থেকে উঠে আমার মুখ দেখতে নেই বুঝি?
না। অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে।
তার মানে?
তার মানে এর পর আর অন্যের মুখ দেখলে সহ্য করতে পারব না।
আপনার অভ্যাস খারাপ করার ক্ষমতা আমার নেই।
কথার মোড় ঘোরালাম, তোমার বাবাকে চা দিয়েছ?
এত ভোরে বাবাকে চা দেব?
কেন? কটা বাজে?
সাড়ে ছটা।
সাড়ে ছটা। আমি আঁতকে উঠি। তাহলে তোমরা কখন এসেছ?
আধ ঘন্টা আগে।
রাত্রে কি ঘুমোওনি?
আপনার জন্য কি ঘুমুবার উপায় আছে?
আমার জন্য ঘুমুতে পার না?
না।
তার মানে?
সব কথার মানে বলতে পারব না। নিন উঠুন। চা খেয়ে নিন।
বৌদি বাথরুম থেকে বেরুবার পর বললাম, স্বামীর জন্য যদি এভাবে ভোরবেলায় ছুটে আসেন তাহলে মেয়ে-জামাই কি শিখবে বলুন তো?
বৌদি হাসতে হাসতে বললেন, ওদের যা কিছু শেখাবার তা তুমি যথেষ্ট শেখাতে পারবে। আমাকে কিছু শেখাতে হবে না।
রাধাকিষণকে নিয়ে বৌদি বাজারে গেলেন। কিছুতেই আমাকে যেতে দিলেন না। মা বললো, মা যখন এসেছেন তখন সংসারের ব্যাপারে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না।