আমি ভেরে পাই না আপনি কি? পশু? নাকি দেবতা? হয় আপনার মধ্যে শৌর্য, বীর্য, ভালোবাসার ক্ষমতা, মন কিছুই আপনার নেই; নয়তো আপনি এমন কোন মেয়ের দেখা পেয়েছেন, ভালোবাসা পেয়েছেন, নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছেন, যার কাছে আমি অতি সাধারণ। অতি নগণ্য। হয়তো তুচ্ছ বা ঘৃণ্য। কোনোটা ঠিক বলুন তো? বলতে পারেন কেন আপনি আমাকে এভাবে উপেক্ষা করেছেন? এভাবে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে? কোনো অধিকারে সারা জীবনের জন্য আমার মনে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন?
থাক গে। ভেবেছিলাম আর আপনার এখানে আসবনা, কিন্তু না এসে পারলাম না। দুদিন এলাম দেখা হলো না। শুনলাম আপনি হঠাৎ জরুরি কাজে বাইরে গেছে। কাজটা যে কত জরুরি তা আর কেউ না বুঝুক আমি বুঝেছি। আমার জন্যই আপনার এই দুর্ভোগ। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি ব্যাঙ্গালোরে ফিরে যাচ্ছি। দাদার জন্য দিল্লিতে আমার আসতেই হবে। তবে কথা দিচ্ছি আপনাকে আর বিরক্ত করব না।
চিঠিটা পড়ে তো অবাক হলামই, তবে আরো বেশি অবাক হলাম নিচের লেখাটুকু দেখে– মিসেস দেবব্রত চৌধুরী।
.
তারপর কত কি হলো! ডক্টর চৌধুরীর বাড়ির গৃহপ্রবেশের নিমন্ত্রণ এলো। দেবু নিজেই এসেছিল। দাদা বার বার বলে দিয়েছে আপনাকে আসার জন্য।
আমি খুব গম্ভীর হয়ে উত্তর দিয়েছি, আসব তো নিশ্চয়ই; তবে খবরের কাগজের কাজ করি তো! কখন যে কোনো কাজে আটকে যাই কিছু ঠিক নেই।
দেবু হাসতে হাসতে বলেছে, তাছাড়া বাড়িটা তো আপনাদেরই রঞ্জনার। সুতরাংনা এলে চলবে না।
অত করে বলার দরকার নেই। যদি খুব জরুরী কোনো কাজে আটকে না যাই তাহলে আসবই।
আমি যাইনি। যেতে পারিনি। রমার সামনে মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস আমার হয়নি। দেবু যখন নেমন্তন্ন করতে এসেছিল তখনই জানতাম যাব না। কিছুতেই যাব না কিন্তু বলতে পারিনি। কি বলব? বলব, দেবুবাবু, আপনার স্ত্রী রমা আমাকে ভালোবাসত। এখনও ভালোবাসে। একদিন সে আমাকে সব কিছু বিলিয়ে দিতে পারত। ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণা হবার জন্য সে উন্মুখ হয়ে আমার কাছে এসেছে, কিন্তু আমি কিছুই দিতে পারিনি। ওকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিয়েছি। একেবারেই কিছু দিইনি। ভালোবেসে প্রত্যাখ্যাত হবার মতো অপমান আর নেই। এর চাইতে বড় ব্যর্থতা, পরাজয়, মেয়েদের জীবনে আসতে পারে না। আমার কাছে রমা এই অপমানে অপমানিত হয়েছে। ওর কাছে মুখ দেখাব কি করে? কোনো সাহসে? প্রেমে প্রত্যাখ্যাত মেয়ে আহত কেউটে বা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের চাইতেও ভয়ঙ্কর। মারাত্মক। আমি আপনাদের এই আনন্দের দিনে যেতে পারব না দেবুবাবু। আমাকে ক্ষমা করবেন।
আমি শিক্ষিত। ভদ্রলোক। ভদ্রসমাজে বিচরণ করি। তাই মনের কথা বলি না। বলার মতো চারিত্রিক দৃঢ়তা, সাহস আমার নেই। অভ্যাস নেই। বরং মনের কথা চেপে রেখে বানিয়ে বানিয়ে মিষ্টি মিষ্টি মিথ্যা কথা বলতে ওস্তাদ। তাই দেবুবাবুকে এসব কিছুই বলিনি। আমি ওর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি। উনি ভেবেছেন আমি নিশ্চয়ই যাব। এমন আনন্দের দিনে আমি ওঁদের পাশে দাঁড়াব না? তাই কি কখনও হয়?
সুভাষদা মস্কো থেকে ফিরে এলেন। আগেই চিঠি পেয়েছিলাম কিন্তু তবুও এয়ারপোর্টে যাইনি।
যে কারণে দেবুদের গৃহপ্রবেশের দিন যায়নি, ঐ একই কারণে পালাম যাইনি। কিন্তু পালামে গিয়ে ওঁদের অভ্যর্থনা করার জন্য মনটা সত্যি বড় ব্যাকুল হয়েছিল। সুভাষদার সংসারে যে মর্যাদা, ভালোবাসা পেয়েছি তার তুলনা হয় না। কত মানুষের সঙ্গেই তো আলাপ হয় কিন্তু কজন এভাবে। আমাকে আপন করে নিয়েছেন? একজন অপরিচিত সাংবাদিকের কাছে এভাবে নিজেদের বিলিয়ে দিতে পারেন? খুব কম। প্রায় দুর্লভ। আমার জীবনের অনেক দৈন্য, অভাব, অপূর্ণতা এরা ভরিয়ে দিয়েছে। এদের কাছে আমার ঋণ অশেষ। সীমাহীন। কল্পনাতীত। মাতৃ ঋণ যদি শোধ করা না যায় তাহলে এদের ভালোবাসার ঋণই বা শোধ করা যাবে কি ভাবে? স্নেহ-ভালোবাসার ঋণ কখনই শোধ করা যায় না। আমি ওঁদের ঋণ থেকে মুক্ত হতে পারব না। চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হব। তাই শুধু কৃতজ্ঞতার বোঝা বহন করা ছাড়া আমার দ্বারা আর কিছু হবে না। আমার সঙ্গে আলাপ হবার পর ওঁরা যতবার দিল্লি দিয়ে আসা-যাওয়া করেছেন, প্রত্যেকবার আমি উপস্থিত থেকেছি। শত কাজের মধ্যেও না যাবার কোনো কারণ হয়নি। হবে কেন? আমি যখন আমেরিকা থেকে ফিরি তখন সুভাষদা আর বৌদি ওঁদের গাড়িতে আমাকে নিউইয়র্ক পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমার মতো একজন সাধারণ সাংবাদিকদের জন্য অন্য কোনো ভারতীয় ডিপ্লোম্যাট আর তার স্ত্রী এত কষ্ট করবেন? কেউ না। শত শত ভারতীয় ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে আমার আলাপ, বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠতা। বিদেশে কত অলস সন্ধ্যা এঁদের সঙ্গে কাটাই। আড্ডা দিই, সিনেমা-থিয়েটারে যাই, লাঞ্চ-ডিনার খাই, হুইস্কির বোতল শেষ করি, কিন্তু সুভাষদা-জয়ন্তী বৌদির মতো কেউ স্বেচ্ছায় হাসি মুখে আমাকে। বিদায় জানাতে আসেন না এয়ারপোর্ট। আমি আশা করি না। আশা করা অন্যায়। সেই সুভাষদা আর জয়ন্তী বৌদি আসছেন কিন্তু গেলাম না। ভাবলেও অবাক লাগে। সুভাষদা রিটায়ার করে ফিরছেন। আর কোনোদিন পালাম এয়ারপোর্ট দিয়ে আসা-যাওয়া করবেন না। তিন-চার বছর পর। পর স্বদেশ-বিদেশের মধ্যে আর খেয়া পারাপার করবেন না। অন্যবার কোনো কারণে এয়ারপোর্টে না গেলেও হয়তো কিছু মনে করতেন না। ভাবতেন, বুঝতেন আমি কোনো কাজে আটকে পড়েছি, কিন্তু এবার মনে মনে একটু আহত নিশ্চয়ই হবেন। হয়তো ভাববেন রিটায়ার করেছে বলে আমি আর ওঁদের গুরুত্ব বা মর্যাদা দিচ্ছি না। হয়তো মনে করবেন আমি ওঁদের উপেক্ষা করলাম। আমি পাল্টে গেছি। আমি আর ওঁদের চাই না। আমার জীবনে ওঁদের ভূমিকা শেষ। জানি না আরো কত কি ভাববেন। এসব ভাবনা হওয়া স্বাভাবিক। অন্যায় নয়। আমি কিছু বলতে পারব না।কিন্তু বিবেক? বিবেকের কাছে তো আমাকে জবাবদিহি করতেই হবে। কি বলব বিবেককে? বলব, আমি ভীরু কাপুরুষ, আমি অকৃতজ্ঞ? বলব, আমি রমার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার মতো মনের জোর, চরিত্রের দৃঢ়তা হারিয়েছি? তাই কি কখনও হয়? ওঁরা এয়ারপোর্টে নেমে নিশ্চয়ই আমার কথা জিজ্ঞাসা করবেন, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারবেন না। যে বলতে পারে সে তত আমার নামও উচ্চারণ করবে না।