.
টেলিফোনের বেল বাজতেই রিসিভার তুলোম। রিসেপসন থেকে মেয়েটি বললল, স্যার, মিঃ চাউডারী ইজ হিয়ার।
ডু প্লীজ সেন্ড হিম টু মাই রুম।
একটু পরেই দরজায় নক করার আওয়াজ হলো। দরজা খুলেই বললাম, আসুন, আসুন।
দেবব্রত ঘরে না ঢুকেই বললো, আমাকে তুমি বলাটাই বোধহয় বেশি সমীচীন হবে, তাই না?
আগে ভিতরে আসুন। তারপর…
ঘরে যখন ডাকছেন তখন ঘরের মতো করে নেওয়াই কি ঠিক নয়?
ইলেকট্রনিক্স ছাড়াও আপনি কি টেম্পলস ইন-এ ব্যারিস্টারি পড়ছেন?
দেবব্রত আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে বললো, ইন ফ্যাকট, দাদা আমাকে ব্যারিস্টার করতেই চেয়েছিলেন।
ইলেকট্রনিক্স পড়ছে কি বাবার অনুরোধে নাকি নিজের ইচ্ছায়?
আমার বাবা নেই। আমার খুব ছেলেবেলায় উনি মারা যান।
কথাটা শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আর কোনো প্রশ্ন করার ইচ্ছা ছিল না কিন্তু হঠাৎ মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, মা আছে তো?
না, তিনিও নেই।
দেবব্রত অত্যন্ত সহজভাবে বললেও আমার মুখ থেকে হাসির শেষ রেশটুকুও উবে গেল। মিনিটখানেক বোধহয় মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়েছিলাম। তারপর আলতো করে ওর একটা হাত ধরে খুব নিচু গলায় বললাম, বসুন।
দু-চার মিনিট দুজনেই চুপ করে বসে রইলাম। তারপর দেবব্রতই প্রথম কথা বললো, বাবা মা না থাকা নিঃসন্দেহে দুঃখের কিন্তু দাদা আমার সব অভাব দুঃখ ভুলিয়ে দেন।
দাদা বুঝি আপনাকে খুব ভালোবাসেন?
দেবব্রত হাসল। ভালোবাসেন বললেই দাদার ভালোবাসা বোঝান যায় না। আমার দাদার মতো দাদা বোধহয় আর কেউ পায়নি, পাবে না। উনি আবার মুখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললেন, হি ইজ সিম্পলি ইউনিক।
দাদার কথা বলতে বলতে ওর সারা মখখানা আনন্দে, গর্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বাবা-মা নেই বলে সামান্যতম দুঃখের চিহ্ন সে মুখে দেখলাম না। একটু বিস্মিত হলাম। চন্দ্র-সূর্যের মতো বাবা মার অভাব নাকি অপূরণীয়। এতকাল এই কথাই শুনে এসেছি, জেনে এসেছি কিন্তু আজ দেবব্রতকে দেখে বুঝলাম, না তা নয়। হিমালয়ের বুক চিরে গঙ্গা বেরিয়ে এসেছে। তার দুধারে অসংখ্য দেবদেবীর মন্দির, তীর্থক্ষেত্র। সে চির পবিত্র। সুখে-দুখে আনন্দ-উৎসবে জীবনে-মরণে গঙ্গার অনন্য ভূমিকা অনস্বীকার্য কিন্তু গোদাবরী কাবেরী, নর্মদা-সিন্ধুও কম পবিত্র নয়। ওদের, দুধারেও অসংখ্য বিগ্রহের মন্দির আছে, আছে তীর্থক্ষেত্র।
গঙ্গা তীরে বাস করতে করতে আমরা অনেকেই ভুলে যাই গোদাবরী কাবেরী নর্মদা-সিন্ধুও সমানভাবে পবিত্র কিন্তু একথা জানতে হলে…
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে দেবব্রত বললে, গোদাবরী কাবেরীর দেখা পাওয়া চাই।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন কিন্তু সবাই তো দেখা পায় না।
ঠিক, কিন্তু আমি পেয়েছি। গোদাবরী কাবেরী নয়, মানস সরোবর পেয়েছি।
হঠাৎ অবিশ্বাস্য মনে হলো, বলেন কি?
বিলিভ মী, আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না।
শুনেছি, পড়েছি ভগবতী দেবীকে পেয়েছিলেন বলে বিদ্যাসাগর মশাইকে কোনো বিগ্রহের পূজা করতে হয়নি। দেবব্রত কি বিদ্যাসাগরের মতোই ভাগ্যবান?
সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে বললাম, নিন।
থ্যাঙ্কস। আমি সিগারেট খাই না।
তাহলে হোয়াট ক্যান আই অফার ইউ?
কিছু দরকার নেই।
খেতে যাবার তো এখনও অনেক দেরি।
বেশ তো গল্প করছি। আমার কিছু লাগবে না।
ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আই ক্যান অফার ইউ এ ড্রিঙ্ক।
আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?
দিল্লি বা কলকাতা হলে চাকফি খেতে খেতে গল্প করা যেতো কিন্তু এখানে এক কাপ চায়ের চাইতে এক পেগ হুইস্কি অফার করা অনেক সহজ।
দেবব্রত হাসল, তা ঠিক।
আপনি ড্রিঙ্ক করেন কি?
করি না বললে মিথ্যা বলা হবে, তবে খুব কম। কদাচিৎ, কখনও আর কি।
শেষ পর্যন্ত দু গেলাস হুইস্কি নিয়েই দুজনে শুরু করলাম গল্প করতে।
কোথায় লেখাপড়া করেছেন?
দিল্লিতে।
সে কি! আপনি দিল্লির ছেলে?
হ্যাঁ, তাই বলতে পারেন। দাদা তো দিল্লিতেই থাকেন।
বরাবরই দিল্লিতে? আপনার বাবাও দিল্লিতে থাকতেন?
শুধু বাবা কেন, আমার গ্রান্ড ফাদারও দিল্লিতে জীবন কাটিয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে বোধহয় বিশেষ যোগাযোগ নেই?
না, একেবারেই নেই। তবে দাদার সঙ্গে দুএকবার হুগলিতে গেছি।
হুগলিতে বুঝি আপনাদের আদি বাড়ি ছিল?
হ্যাঁ।
গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়ার হেড কোয়ার্টার্স কলকাতা থেকে দিল্লি আনার সঙ্গে সঙ্গেই বহু বাঙালী পরিবার বাংলাদেশ থেকে দিল্লিতে চলে আসেন।
আমাদের ফ্যামিলি কিন্তু গভর্নমেন্ট মুভ করার জন্য দিল্লি আসে না।
তবে?
সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। অ্যান্ড ইন্টারেস্টিং টু।
০২. নরহরি চৌধুরী কোম্পানির দপ্তরে
নরহরি চৌধুরী কোম্পানির দপ্তরে নানা ধরনের নথিপত্রের দেখাশুনা করতেন। মাইনে পেতেন অতি সামান্য। বোধহয় সাত বা আট টাকা। দুঃখে কষ্টে কোনোমতে সংসার চলে। হঠাৎ বুড়ো সাহেব বদলী হয়ে বিলেত চলে গেলেন, এলেন এক ছোঁকরা সাহেব। দু চার মাস যেতে না যেতেই সাহেব কাজকর্ম দেখা প্রায় ছেড়ে দিলেন। নরহরির উপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে সাহেব জানবাজারের এক বড়লোক বাঙালিবাবুর সঙ্গে রোজ বাইজিদের নাচ দেখতে শুরু করলেন। খুব জরুরী কাজকর্ম থাকলেও নরহরি নথিপত্র নিয়ে বাইজি বাড়ি হাজির হয়ে সাহেবের শরণাপন্ন হতো। খুব বেশি। মদ না খেলে সাহেব নথিপত্র সই করে নরহরিকে বিদায় করতেন কিন্তু মদ্যপান একটু বেশি হলে। বা বাঈজির নাচ বেশি জমে উঠলেই মুশকিল হতো। সাহেবনথিপত্রে সই তো দিতেনই না, উপরন্তু নরহরিকেও আটকে রাখতেন।