রঞ্জনা হঠাৎ থামল।
আমি চুপ করে রইলাম। দু এক মিনিট পরে মুখ ঘুরিয়ে দেখি ওর চোখে জল। কাঁদছ কেন রঞ্জনা? কি হয়েছে তোমার?
রঞ্জনা বিদ্যুৎ বেগে সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ফেলেই ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বললো, চলি।
রঞ্জনা। শোন!
আমি ওর পিছন পিছন যেতে যেতে আবার ডাকলাম, একটা কথা শুনে যাও রঞ্জনা। এক মিনিট…
ও দাঁড়াল না। গাড়িতে উঠেই ড্রাইভারকে বললো, সাহাব কা দপ্তর চলো।
রঞ্জনা আমার দিকে একবারও তাকাল না। ড্রাইভার হাত তুলে আমাকে একটা সেলাম দিয়েই গাড়ি স্টার্ট করল। রঞ্জনা চলে গেল। আমি ঐখানেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ পর্যন্ত নড়তে পারলাম না। হঠাৎ আমার সব কিছু অসহ্য মনে হলো। এক মিনিটের জন্য আর দিল্লি থাকতে মন চাইল না।
.
তাড়াতাড়ি বাড়ির মধ্যে এসেই নিউজ এডিটরকে একটা ফনোগ্রাম পাঠালাম, গোয়িং আউট অফ ডেলহি ফর অ্যান ইন্টারেস্টিং নিউজ।
এবার রাধাকিষণকে ডেকে বললাম, আমি খুব জরুরী কাজে বাইরে যাচ্ছি।
ফিন বাইরে যাবেন?
হ্যাঁ।
কব?
আজ।
রাধাকিষণ অনেক কাল ধরে আমার কাছে কাজ করছে। আমাকে ও ভালোভাবেই চেনে, জানে। বুঝল কিছু একটা অঘটন ঘটেছে, কিন্তু হাজার হোক আমি মনিব, ও আমার ভৃত্য। একটি প্রশ্নও করল না।
সন্ধ্যার পর আমি একটা অ্যাটাচিতে কয়েকটা জামাকাপড় ভরে নিয়েই দিল্লি জংশন স্টেশনে রওনা হলাম। রিজার্ভেশন পেলাম না। তবু মুসৌরী এক্সপ্রেসে চড়ে ডেরাডুন গেলাম। পরের দিনই মুসৌরী।
দিল্লি থেকে পালিয়ে এলাম ঠিকই, কিন্তু মন? তার কাছ থেকে কোথায় পালাব। হকম্যানস গ্রান্ড-এ থেকেও ভালো লাগছিল না। দুটো দিন ঘর থেকেই বেরুলাম না। তার পরদিন আর পারলাম না। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে টিকিটের খোঁজ করলাম। সেদিনকার টিকিট ছিল না। পরের দিনের একটা টিকিট কিনে হোটেলে ফিরে এলাম।
চারদিন পর দিল্লি ফিরলাম। বাড়িতে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই রাধাকিষণ আমার হাতে একটা খাম দিল, তিন মূর্তি লেনের মেমসাব দুদিন এসে আপনাকে না পেয়ে এই চিঠি দিয়ে গেছেন।
বিচিত্র চিঠি। কোনো কিছু বলে সম্বোধন নেই। …আপনাকে এই প্রথম চিঠি লিখছি অথচ কিছু বলে সম্বোধন করতে পারছি না বলে ক্ষমা করবেন। তা ছাড়া কি বলে সম্বোধন করব? যা বলে সম্বোধন করতে মন চায় তা তো সম্ভব নয়।
প্রথমবার আপনি যখন বেনারসে এসে আমার সঙ্গে দেখা করলেন, তখনই আপনাকে ভালো লেগেছিল। আপনার মুখের হাসি, উদার দুটো চোখ, প্রাণ-প্রাচুর্য আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আপনি চলে যাবার পরমুহূর্ত থেকেই আবার আপনার আসার প্রতীক্ষায় থেকেছি। বার বার লুকিয়ে লুকিয়ে আপনার ওয়াশিংটনের ফটোগুলো দেখেছি আর ছোট-ছোট টুকরো-টুকরো কাগজে আপনাকে চিঠি লিখেছি। সেসব চিঠি কোনদিন আপনাকে পাঠাইনি। পাঠাতে পারিনি। সাহস হয়নি।
আস্তে আস্তে আপনাকে যত দেখেছি তত বেশি ভালো লেগেছে আর নিত্য নতুন স্বপ্ন দেখেছি মনে মনে। দেখব না কেন? আপনি যেভাবে আমার সঙ্গে মিশেছেন, যেভাবে দিনে দিনে, ধাপে ধাপে আমার কাছে এগিয়ে এসেছেন, আমাকে আপন জ্ঞানে কাছে নিয়েছেন, ভালোবাসার আভাস ইঙ্গিত-প্রমাণ দিয়েছেন, তাতে স্বপ্ন দেখা অন্যায় মনে হয়নি। বরং স্বাভাবিক মনে হয়েছে। মনে হয়েছে আপনাকে ভালোবাসার, আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার অধিকার আপনি আমাকে দিয়েছেন।
তারপর একদিন হোস্টেলের মেয়েদের কাছে ধরা পড়লাম। হাজার হোক এক ঘরে থাকি, একসঙ্গে লেখাপড়া করি, সিনেমা দেখি। বেড়াতে যাই। কতদিন আর ওদের কাছ থেকে লুকিয়ে। রাখা সম্ভব? ওরা কি দারুণ ঠাট্টা-ইয়ার্কি করত তা আপনি ভাবতে পারবেন না। হোস্টেলে তো। কোনোদিন থাকেননি, তাই ভাবতে পারবেন না মেয়েদের ভালোবাসার কথা, প্রেমের কাহিনি ফাস হয়ে গেলে কি কাণ্ড হয়। আমি যখন ফিফথ ইয়ারে উঠি তখন আপনার বয়সীই একজন বাঙালি লেকচারার আমার প্রতি একটু আকৃষ্ট হয়েছেন বলে হোস্টেলের গোয়েন্দা বিভাগে খবর পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গেই ওর কাছে বেনামী চিঠি চলে গেল, আপনার চাইতে অনেক সুন্দর, ব্রিলিয়ান্ট এক জার্নালিস্টের সঙ্গে ওর বিয়ে হবে বলে ঠিক হয়ে গেছে। সুতরাং মন দিয়ে অধ্যাপনা করুন আর রবিবারের আনন্দবাজার-যুগান্তরে পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন পড়ুন।
চিঠিতে কি সব কথা জানান যায়? তাছাড়া দুই ভাইকে ফাঁকি দিয়ে এই চিঠি কি ভাবে লিখছি তা আপনি ভাবতে পারবেন না। অনেক কষ্ট করে এই চিঠি লিখছি। না লিখে পারছি না। আপনি যে কি তা আমি ভেবে পাই না। রাজনীতির এত গোপন খবর জোগাড় করেন অথচ প্রকাশ্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট, উন্মুক্ত আমার ভালোবাসা আপনি বুঝতে পারলেন না? ভালো না বাসলে কোন মেয়ে এভাবে একজন ব্যাচেলারের সঙ্গে মিশতে পারে? সকালে, দুপুরে, সন্ধ্যায়, রাত্রিতে একা একা তাকে সাহচর্য দিতে পারে? শুধু দেহটাই আপনাকে দিইনি, কিন্তু তাছাড়া আর কি দিই নি? সেবা, যত্ন, ভালোবাসা, সম্মান, মর্যাদা–সব কিছুই তো দিয়েছি। আনন্দে, হাসি মুখে দিয়েছি। আর যদি দাবি করতে পারতেন তাহলে হয়তো এই দেহটাকেও না দিয়ে পারতাম না। আপনার মধ্যে অনেক দ্বিধা, জড়তা, সঙ্কোচ থাকলেও আমার মধ্যে ছিল না। একবার নয়, ৰবার তো সুযোগ পেয়েছে। কতদিন শুধু আমি আর আপনি আপনার পড়ার ঘরে, শোবার ঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি বলুন তো। রাধাকিষণ তো সেই পিছনের দিকে নিজের কোয়ার্টারে ঘুমুতো। একবার দাবি করেই দেখতে পারতেন ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণা হই কিনা। যে মেয়ে প্রাণ মন উৎসর্গ করতে পারে, ভালোবাসার জন্য লোকলজ্জা, সামাজিক অনুশাসন উপেক্ষা করতে পারে, তার পক্ষে প্রাণের মানুষের কাছে দেহটাকে বিলিয়ে দেওয়া কিছু দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। ভালোবাসার খেসারত দিতে গিয়ে শুধু মেয়েরাই সমাজের কাছে কলঙ্কিনী হয়, ছেলেরা নয়। কখনই নয়। ভালোবাসার বিনিময়ে দুর্নাম সহ্য করার সাহস বা ক্ষমতা আপনাদের হয় না। হবে না।