আমি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলাম, এই দুটো বেডরুমই বুঝি আপনাদের দু ভাইয়ের?
ডক্টর চৌধুরী হাসতে হাসতে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আপনার মাথা খারাপ হয়েছে? রঞ্জনা আর ওর ছেলেমেয়েরা আমাকে এত কাছে থাকতে দেবে? আমি থাকব উপরের একটা ঘরে।
আমি হাসলাম।
এর একটা ঘরে রঞ্জনারা, অন্যটায় আমার ফিউচার গার্ডিয়ানরা থাকবে।…
আমি না হেসে পারলাম না।
এটা হচ্ছে ওপেন প্লেস। এর পর এটা স্টাডি। জ্যেঠু এখানে পড়াশুনা করবে আর একেবারে কোণায় হচ্ছে একটা গেস্ট রুম। প্ল্যানটা কেমন লাগল বলুন?
খুব ভালো, কিন্তু আপনার কি ব্যবস্থা হবে?
ঐ তো সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলেই দুটো ঘর। একটায় পড়াশুনা করব আর অন্যটায় শোব।
প্ল্যানের কাগজটার ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিতে গিয়েই জিজ্ঞাসা করলাম এখানে কি হবে?
ও। গ্যারাজ আর সারভেন্টস কোয়ার্টার।
দেবু আমার পাশেই ছিল। আমার কানে কানে জিজ্ঞাসা করল, রঞ্জনাকে জিজ্ঞেস করুন তোত আমি কি গ্যারাজের ওপরেই থাকব?
আমি হাসলাম, এ দুশ্চিন্তার কারণ?
ও আবার আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো, দাদার বাড়ি হলে তো ভয় ছিল না। বাড়ির মালিক তো রঞ্জনা হচ্ছে।
আমাদের দুজনকে এমন ফিসফিস করে কথা বলতে দেখে রঞ্জনা আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি একবার ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
হঠাৎ ডক্টর চৌধুরী একটু গলা চড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, জানেন তো রিপোর্টার সাহেব, এ বাড়ির নাম কি হবে?
কই না তো।
বাড়ির নাম হবে রঞ্জনা।
হাজার হোক খবরের কাগজের রিপোর্টার। কিছু কিছু মিনিস্টার আর এম-পির সঙ্গে এত আজে বাজে আড্ডা দিই আর ইয়ার্কি করি যে মাঝে মাঝে যেখানে-সেখানে বেফাঁস কথা বলে ফেলি। বাড়ির নাম রঞ্জনা হবে শুনেই হঠাৎ বলে ফেললাম, আপনার মতো ভাশুর পেলে বোধ হয় অনেক হিন্দু বিধবাও আবার বিয়ে করতে রাজি হবে।
কথাটা জিব ফসকে বেরিয়ে যেতেই খারাপ লাগল, কিন্তু ওঁরা তিনজনেই হাসলেন দেখে নিশ্চিন্ত হলাম।
বাড়ি তৈরির জন্য দেবু সারাদিনই ব্যস্ত থাকত। সন্ধ্যার পর হয় দাদার সঙ্গে সারাদিনের কাজকর্ম নিয়ে কথাবার্তা বলতো, নয়তো ক্লান্তিতে শুয়েই পড়ত। কলকাতা থেকে আমার এক বন্ধুর দাদা-বৌদি দিল্লি বেড়াতে এসে আমার কাছেই ছিলেন। ওঁদের কুতুব মিনার দেখিয়ে ফেরার পথে। পঞ্চশীল কলোনীতে গিয়েছিলাম। রঞ্জনা আর দেবু দুজনেই ছিল। ঐ একমাসের মধ্যে দেবুরা একদিন আমার এখানে এসেছিল। আমিও বোধহয় দুদিন খেতে গিয়েছি।
এর মাস দুয়েক পরে রঞ্জনা যখন আবার এলো তখন আমি এখানে নেই। আসাম গেছি। ফেরার পথে কলকাতা। ভেবেছিলাম দু-তিন দিন থাকব, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কলকাতা ছাড়লাম নদিন পর। ফিরে এসেই রাধাকিষণের কাছে শুনলাম তিন মূর্তি লেনের মেমসাব অনেক দিন দিল্লিতে। জিজ্ঞাসা করলাম, মেমসাহেব কি টেলিফোন করেছিলেন?
টেলিফোন তো হরদমই করেন। দুদিন এসেও ছিলেন।
তাই নাকি?
জী হাঁ। বড় চৌধুরী সাহেবও দুদিন টেলিফোন করেছিলেন।
ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে এগারটা বাজে। তাহলে খুব বেশি বেলা হয়নি। রাধাকিষণ, আমি বাথরুমে যাচ্ছি। তুমি তিন মূর্তি লেনের মেমসাহেবকে বলে দাও আমি ওখানে খেতে যাচ্ছি।
আমি তাহলে খানা বানাব না?
না।
বেরুতে বেরুতে সাড়ে বারোটা হয়ে গেল। তারপর গ্যারেজে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট করতে গিয়ে দেখলাম ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেছে। তখন আর কি করব! ট্যাকসি নিয়েই চলে গেলাম।
রঞ্জনা আমাকে দেখেই মন্তব্য করল, তাহলে ফিরেছেন দেখছি।
ফিরব না তো কোথায় যাবো?
কোথায় যান, কোথায় থাকেন, তা আপনিই জানেন।
তার মানে?
কথা বলতে বলতেই ড্রইংরুমে ঢুকলাম। রঞ্জনা বললো, সত্যি বেশ আছেন আপনি। কোনো চিন্তা-ভাবনা দায়-দায়িত্ব নেই! যা ইচ্ছে তাই করছেন।
কোথায় যা ইচ্ছে তাই করছি? কাজে আসাম গিয়েছিলাম আর ফেরার পথে কদিন কলকাতায় ছিলাম।
রঞ্জনা কিছু বলার আগেই আমি আবার বললাম, আমি খেতে এসেছি।
আমি জানি। রঞ্জনা একবার আমাকে দেখে বললো, আপনার মতো জার্নালিস্টদের সংসার ধর্ম না করাই ভালো।
সেই জন্যই তো করিনি।
না করে খুব ভালো করেছেন, কিন্তু আমি আপনার মতো কোনো জার্নালিস্টের হাতে পড়লে তো মরেই যেতাম।
ওর কথা শুনে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। কি আজেবাজে কথা বলছ?
রঞ্জনা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, যাই খাওয়ার ব্যবস্থা করি।
খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে উঠলাম। রঞ্জনাও বাইরে বেরিয়ে এলো। চারপাশ তাকিয়ে আমার গাড়ি দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, গাড়ি কোথায় রেখেছেন?
গাড়ি আনিনি।
কেন?
স্টার্ট নিতে গিয়ে দেখি ব্যাটারি ডাউন হয়ে গিয়েছে।
খবরটা শুনে ও যেন খুশীই হলো, মাসের পর মাস গাড়ি পড়ে থাকলে ব্যাটারীর কি দোষ?
আমি কি বলব? শুধু হাসলাম।
তাহলে কিসে এলেন?
কেন ট্যাক্সিতে।
এখন কি ট্যাক্সি করেই ফেরত যাবেন?
তবে আর কিসে যাব?
দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমি দাদাকে ফোন করে গাড়ি আনিয়ে নিচ্ছি।
কোনো দরকার নেই…
ও আমার কথা না শুনেই বাড়ির মধ্যে চলে গেল। আমি ঐখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। দু-তিন মিনিট পরেই রঞ্জনা বেরিয়ে এলো। একটু বসুন। এক্ষুনি গাড়ি আসছে।
আমি ওর পিছন পিছন ড্রইংরুমে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, কোনো দরকার ছিল না রঞ্জনা।
আপনি চুপ করুন। চু