পাঁচ, দশ, পনের মিনিট। আধঘণ্টা। একঘণ্টাও পার হয়ে গেল। কিন্তু আমার টেলিফোন বেজে উঠল না। আরো আধঘণ্টা হয়ে গেল তবু টেলিফোন এলো না। হঠাৎ কলিং বেল বাজতেই চমকে উঠলাম। ভাবলাম নিশ্চয়ই পিয়ন এসেছে কোনো রেজিস্টার্ড বুক-পোস্ট ডেলিভেরী দিতে। দরজা খুলে দেখি রঞ্জনা। মিটমিট করে হাসছে। হাতে টিফিন কেরিয়ার।
এসো। আমারও হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু অনেক কষ্টে হাসি চেপে স্বাভাবিকভাবে ওকে ডাকলাম।
ও ধীর পদক্ষেপে ড্রইংরুমে ঢুকে সেন্টার টেবিলের ওপর টিফিন কেরিয়ার রেখে একটা সোফায় বসল। মিটমিট করে হাসতে হাসতেই আমার দিকে তাকিয়ে রইল। মুখে কোন কথা নেই।
অমন করে কি দেখছ?
ঠিক একই রকম ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে বললো, দেখে মনেই হয় না ভিতরে ভিতরে এত দুষ্ট বুদ্ধি।
ন্যাকামি করে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? আমি কি করেছি?
ও মাথা দোলাতে দোলাতে বললো, কিচ্ছু না।
কথার মোড় ঘোরাবার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম, টিফিন কেরিয়ার খালি না ভর্তি?
রাধাকিষণ কোথায়?
ছুটিতে।
আবার ছুটিতে?
দুদিনের জন্য গড়মুক্তেশ্বরের মেলা দেখতে গেছে।
কবে গেছে?
আজই ভোরে।
তাহলে খাওয়া হয়নি?
খাওয়া হয়নি বলেই গাড়ির দরজায় পাটা এমন বিচ্ছিরিভাবে জখম হলো।
ও টিফিন কেরিয়ারটা হাতে ভিতরের দিকে যেতে যেতে আপন মনে বললো, এই না হলে জার্নালিস্ট।
আমি চুপ করে বসে রইলাম।
একটু পরে ডাইনিং টেবিলে খাবার-দাবার সাজিয়ে রঞ্জনা ডাকল, আসুন!
ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি খেয়ে এসেছ?
হ্যাঁ।
সত্যি বলছ?
আপনার মতো সাজিয়ে-গুছিয়ে মিথ্যে বলার মতো ক্ষমতা আমার নেই।
তুমি রাগ করেছ?
ভাত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
বসলাম। ভাতে হাত দিতেই অবাক হলাম, ভাত তো দারুণ গরম, তুমি কি এক্ষুনি রান্না করে নিয়ে এলে?
আমি রান্না করিনি। রান্না করিয়ে নিয়ে এলাম।
এত গরম ভাত আনার কি দরকার ছিল?
আমি জানি আপনি ঠাণ্ডা ভাত খেতে পারেন না।
কিন্তু…
খেয়ে নিন তো! আর বকবক করতে হবে না।
আমি আর একটি কথা না বলে মুখ বুজে খেয়ে নিলাম। ডাইনিং টেবিলে বসেই মুখ নিচু করে বললাম, তোমাকে কষ্ট দিলাম ঠিকই, কিন্তু খুব ভালো লাগল।
এভাবে কতদিন চলবে?
তুমি যতদিন চালাবে।
আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে রঞ্জনা উঠল, যাচ্ছি। রাত্রে ড্রাইভারকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দেব।
আমি হাসলাম, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
রঞ্জনা হাসতে হাসতে বললো, পায়ের ব্যথা না সারা পর্যন্ত তো দেখাশুনা করতে হবে।
অনেক হয়েছে। আর না।
দাদার হুকুম।
০৬. ভালোবাসার অনেক জ্বালা
ভালোবাসার অনেক জ্বালা, অনেক ঝঞ্জাট। যাদের ভালোবাসা যায়, তাহা হাসলে হাসতে ইচ্ছা করে, দুঃখ পেলে নিজের মনটাও পীড়িত হয়। হবেই। সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়বেই। এর থেকে নিস্তার নেই, মুক্তি নেই। একদিন আমি সব কিছু পেয়েছিলাম, পরিপূর্ণ পরিতৃপ্ত হয়েছিল আমার মন। তারপর সব হারিয়েছি। নতুন করে পরিপূর্ণ হবার সাধ নেই। সাধ্যও নেই। তাছাড়া প্রয়োজনও নেই।
বেশ আছি আমি। দিনগুলো বেশ কেটে যায়। রাজনীতি দলাদলি মারামারি কাটাকাটি। কিছু শুনি, কিছু দেখি, লোকে কিছু বলে যায়। টাইপ রাইটার খটখট করি। টেলেক্স টেলিপ্রিন্টারে চলে যায় অফিসে। পরের দিন কাগজে ছাপা হয় ফ্রম আওয়ার পলিটিক্যাল করসপন্ডেন্ট। আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ ককটেল–ডিনারে সন্ধ্যা, রাত্রিও কেটে যায় বেশ। এছাড়াও আছে বন্ধুবান্ধব, পরিচিতের দল। আর আছে রাধাকিষণ। সব মিলিয়ে বেশ আছি। সুখেই আছি। সুভাষদা বৌদি দেবুরঞ্জনার মতো কিছু লোকের জন্যই আমার ঝামেলা। আমি একা হয়েও একলা থাকি না। এদের কথা ভাবি। ভাবতে ইচ্ছা করে, ভালো লাগে। এদের দেখতে ইচ্ছা করে, এদের সঙ্গে কথা বলতে মন চায়। আরো কত কি! মনের ইচ্ছা, প্রাণের ব্যাকুলতাকে সংযত করা বড় কঠিন। কষ্টকর। অনেক সময় দুঃসাধ্যও বটে।
রঞ্জনা দিল্লি আসে, ব্যাঙ্গালোরে ফিরে যায়। দুতিন মাস অন্তরই আসা-যাওয়া। এর মধ্যে দেবুও এক মাসের ছুটি নিয়ে এসেছিল। ঠিক বেড়াতে নয়, কাজে। পঞ্চশীল কলোনীতে ডক্টর চৌধুরী নিজের বাড়ি তৈরি করছেন। ঐ বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করার জন্যই দেবু ছুটি নিয়ে দিল্লি এসেছিল। দেবু আর রঞ্জনা আসার পরদিনই ভিত পূজা হলো। দেবু বার বার করে আমাকে যেতে বলেছিল। গিয়েছিলাম। পুজো শেষ হবার পর আর্কিটেকটের কাছ থেকে প্ল্যানের নীল কাগজখানা নিয়ে ডক্টর চৌধুরী আমাকে বাড়ির প্ল্যান বুঝাতে শুরু করলেন, এই হচ্ছে সামনের বারান্দা। বাঁ দিকের দরজা দিয়ে ঢুকলেই ছোট্ট একটা সিটিং রুম। ড্রইংরুম হবে এল শেপের। আঙুল দিয়ে দেখালেন এই এল শেপের সাইডে হবে ডাইনিং স্পেস। তবে এখানে আমি ডিনার ওয়াগন ফিট করব না।…
আমি বললাম, খুব ভালো। বাইরের লোককে কিছু ক্ৰকারিজ দেখাবার কোনো মানে হয় না।
দ্যাটস রাইট। সিটিংরুম আর ড্রইংরুমের মাঝখানে যে দরজা দেখছেন…
হ্যাঁ।
ঐ দরজার সামনেই একটা বড় ল্যান্ডিং থাকবে আর ল্যান্ডিং-এর এক পাশ দিয়ে দোতলার সিঁড়ি।
আই সী।
ল্যান্ডিং পার হলেই ডান দিকে কিচেন-প্যান্ট্রি-স্টোর। আর বাঁ দিকে পর পর দুটো বেড রুম। দুটোর সাইজ আঠারো বাই কুড়ি। দুটোর সঙ্গেই অ্যাটাচ বাথ অ্যান্ড টয়লেট।…