আমি বিদেশিনী হবে কেন?
যখন তোমার বিয়ে হলো তখন তো তুমি মস্কোর বাসিন্দা।
রঞ্জনা চুপ করে থাকে।
শুনেছি আমাকে নিয়েও আলোচনা হতো। কোনো না কোনো প্রসঙ্গে হয়তো আমার কথা উঠত। আচ্ছা রঞ্জনা, রিপোর্টার সাহেবের সঙ্গে তোমাদের আলাপ কি অনেক দিনের?
উনি যখন ডক্টর রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে আমেরিকায় যান তখনই বাবা-মার সঙ্গে ওঁর প্রথম আলাপ।
তাহলে তো খুব বেশি দিনের আলাপ নয়।
না, খুব বেশি দিনের না হলেও খুব ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছে বাবা-মার সঙ্গে।
তোমার বাবা-মা ওঁকে খুব ভালোবাসেন।
উনিও বাবা-মাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন।
কোনো কোনো দিন আলোচনা আরো এগিয়ে যায়।
রিপোর্টার সাহেব আর দেবুর মধ্যেও দারুণ ভাব তা জান?
রঞ্জনা একটু হাসে, জানি।
লন্ডনে দেবুর সঙ্গে প্রথম আলাপ হবার পর আমার কাছে ওর খুব প্রশংসা করেছিলেন। তুমি। তো জান যে কেউ দেবুর প্রশংসা করুক তাকে আমার ভালো লাগে।
এটা ঠিক বললেন না দাদা।
কেন?
আপনার ভাইয়ের প্রশংসা করলেই ভালো আর প্রশংসা না করলেই ভালো নয়?
আমি ঠিক তা বলিনি।
আপনার কথা শুনে মনে হলো উনি আপনার ভাইয়ের প্রশংসা করেছিলেন বলেই ওকে আপনার ভালো লেগেছে।
ডক্টর চৌধুরী একটু জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে রঞ্জনার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভদ্রলোককে এমনি আমার ভালো লেগেছে। দেখতে-শুনতে আলাপেব্যবহারে বেশ সুন্দর তবে…
তবে ভাইয়ের প্রশংসা করায় আরো ভালো লেগেছে তাই তো।
ডক্টর হাসতে হাসতে বললেন, তা ঠিক।
এরপর আপনার ভাইয়ের সঙ্গে যদি আমার কোনদিন একটু মতবিরোধ বা তর্ক হয় তাহলেই তো আপনি বলবেন, রঞ্জনা মেয়েটা ভালো না।
না, তা বলব কেন? তবে তোমাদের মধ্যে তর্ক ঝগড়া হবেই না।
সংসারের অভিজ্ঞতা প্রায় না থাকলেও রঞ্জনা ওঁর কথায় হাসল। দাদা, আপনি চিরকাল ল্যাবরেটারিতে কাটিয়ে মানুষকে বড় সহজ সরল মনে করেন।
পরে টেলিফোনে ও আমাকে সব কথা জানাত। আমি শুনে হাসতাম।
ডক্টর চৌধুরী আগে সকালে কিছুই খেতেন না। এখনও বিশেষ কিছু খান না। রঞ্জনার অনুরোধে সামান্য একটু ফল খান। সাড়ে নটাতেই ভাত খেয়ে প্ল্যানিং কমিশনে চলে যান। বিকেলের দিকে এক কাপ চা। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে রঞ্জনার চাপে কিছু খেতেই হয় কিন্তু অধিকাংশ দিনই দেরি করে ফেরেন। সাতটা-সাড়ে সাতটা-আটটা বেজে যায়। মিটিং কনফারেন্স ডেলিগেশনের ঝামেলা থাকলে আরো রাত হয়। অফিস থেকে মাঝে মাঝে বাড়িতে টেলিফোন করে রঞ্জনার খবর নেন। কাজের চাপ বেশি থাকলে তাও ভুলে যান। রঞ্জনা অবশ্য রোজই দু তিনবার ফোন করে বলে, দাদা, বাবার চিঠি এসেছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আপনারও চিঠি আছে।
ওরা কেমন আছেন?
ভালোই, তবে আপনাকে একবার যেতে লিখেছেন।
ডক্টর চৌধুরী হাসেন মস্কো যদি বিহার মধ্যপ্রদেশের মধ্যে হতো তাহলে হয়তো একবার চেষ্টা করতাম, কিন্তু…
কেন আপনি কি মস্কো যেতে পারেন না?
সরকার পাঠালেই যেতে পারি।
বাবার তো রিটায়ার করার টাইম হয়ে এলো।
সে এখনও অনেক দেরি।
তিন মূর্তি লেন থেকে বাজার অনেক দূরে। সময় কাটাবার জন্য রঞ্জনা আরো দূরের মার্কেটে যায়। কোনদিন আই-এন-এ মার্কেট, কোনোদিন গোল মার্কেট। বেশ খানিকটা সময় লাগে, কিন্তু তবু সারাটা দিন কাটতে চায় না। পারে না। অসহ্য মনে হয়। বরাবর হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করে একলা থাকার অভ্যাস নেই।
হ্যালো, আমি রঞ্জনা।
বলো কেমন আছো?
একবার টেলিফোনও করেন না কেন বলুন তো?
হঠাৎ টেলিফোন করেই টপ্পা-ঠুংরী গাইতে শুরু করলে কেন?
সব সময়ই আপনার ঠাট্টা। সত্যি বলুন তো আপনি টেলিফোন করেন না কেন?
কে টেলিফোন করল তাতে কি আসে যায়? কথা তো হচ্ছে রেগুলারই।
টেলিফোন করলে কথা না বলে কি করবেন? বাধ্য হয়েই বলতে হয়।
তোমার মেজাজটা খারাপ কেন বলো তো?
মেজাজটা খারাপ হবে কেন। তবে সারাটা দিন একলা থাকতে বিশ্রী লাগে।
আমি কি করতে পারি বল?
কি আবার করবেন?
তবে আর এসব কথা বলে লাভ কি?
ঠিক আছে বলব না। ঝপাং করে টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখল রঞ্জনা।
মনে হলো একবার টেলিফোন করি, কিন্তু করলাম না। কিছুক্ষণ পরে মাথায় একটু দুষ্ট বুদ্ধি এলো। ডক্টর চৌধুরীকে প্ল্যানিং কমিশনে টেলিফোন করলাম, কেমন আছেন?
ভালোই। আপনার খবর ভালো তো?
আমার শরীরটা বিশেষ ভালো নেই।
স্নেহপ্রবণ ডক্টর চৌধুরী একটু উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললেন, কেন, কি হলো? জ্বর নাকি?
জ্বর হয়নি। গাড়ির দরজা বন্ধ করতে গিয়ে ডান পায়ে দারুণ লেগেছে…
তাই নাকি?
হ্যাঁ। একেবারে শয্যাশায়ী।
তাহলে তো খুবই মুশকিল।
চাকরটা না থাকায় আরো বিপদে পড়েছি।
সেকি? খাওয়া-দাওয়ার কি হচ্ছে?
সুন্দর নগর মার্কেটের একটা দোকানে টেলিফোন করলে ওরা কিছু পাঠিয়ে দেয়।
মাই গড! ইউ আর রিয়েলি ইন ট্রাবল!
রঞ্জনা ভালো আছে?
হ্যাঁ, ভালোই আছে, কিন্তু আপনিই তো ভাবিয়ে তুললেন।
আপনি চিন্তা করবেন না। দুএকদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।
.
রাধাকিষণ দুদিনের ছুটি নিয়ে গড়মুক্তেশ্বরের মেলা দেখতে গেছে। আজই ভোরে গেছে। পরশু সন্ধ্যার পর ফিরবে। সকালে ডিম রুটি খেয়ে অফিসে গিয়েছিলাম, আবার বিকেলে খাবো। ফরেন অফিসের ব্রিফিং আছে। দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়া করে একটা ঘুম দেব ভাবছিলাম, কিন্তু বাড়ি ফিরে রাধাকিষণকে না দেখতে পেয়েই মেজাজ বিগড়ে গেল। তারপর রঞ্জনার টেলিফোন। প্রথমে ভেবেছিলাম রাত্রে খেতে বলবে। নেমন্তন্ন তো করলই না উপরন্তু রাগ করে কথাবার্তা বললো। হঠাৎ বাতিক চাপল ওর হাতের রান্না খেতেই হবে। সেই জন্যই ডক্টর চৌধুরীকে টেলিফোন করে ঐসব মিথ্যে কথা বললাম। আশা করেছিলাম উনি সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জনাকে টেলিফোন করবেন। আর তারপরই আমার টেলিফোন বেজে উঠবে।