কিন্তু।
ওসব কিন্তু ছাড়ুন। এক্ষুনি ঘুম থেকে উঠলেন?
হ্যাঁ।
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে চলে আসুন।
শুধু সেদিন রাত্রে নয় পাঁচ-সাত দিন পর পরই ওদের ওখানে নেমন্তন্ন খেতে যেতাম। যেতেই হতো। রঞ্জনা তত বলতই, তাছাড়া ডক্টর চৌধুরী নিজেও অনুরোধ করতেন, আজ কিন্তু তাড়াতাড়ি আসবেন।
আমি একটু সঙ্কোচ বোধ করতাম, এইতো সেদিন গিয়ে খেয়ে এলাম। আজ আবার…
আপনি মশাই বড় লাজুক। খাওয়া-দাওয়া ব্যাপারে ব্যাচেলারের লজ্জা করলে চলে?
আমি একটু হাসলাম, লজ্জার কিছু নয় তবে।
ওসব তবে টবে ছাড়ুন। সাতটার মধ্যে নিশ্চয়ই আসছেন।
আচ্ছা।
আমাকে যেতেই হতো, না গিয়ে পারতাম না। আর ওখানে যাওয়া মানেই রঞ্জনার প্রশংসা শোনা।
ডক্টর চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন, রঞ্জনা কি ডেঞ্জারাস মেয়ে তা আপনি জানেন?
আমি হাসি।
আমার মতো ঘুম কাতুরে লোককে পর্যন্ত ও ভোর পাঁচটায় উঠিয়ে দেয়।
কেন?
মর্নিং ওয়াক করতে পাঠায়।
আমি বলি, মর্নিং ওয়াক করা সত্যি ভালো।
ভালো তো বুঝি কিন্তু আপনি করেন?
দুকাপ কফি নিয়ে রঞ্জনা ড্রইংরুমে ঢুকেই বললো, কি দাদা! আমার প্রশংসা করতে শুরু করেছে?
ডক্টর চৌধুরী ডান হাত বাড়িয়ে কফির পেয়ালা নিতে নিতে বললেন, প্রশংসা নয়, নিন্দা করছি। সারা জীবনে যে সাড়ে সাতটা-আটটার আগে ঘুম থেকে ওঠেনি, আর তাকে তুমি পাঁচটার সময় মর্নিং ওয়াকএ পাঠাচ্ছ আর আমি তোমার নিন্দা করব না?
রঞ্জনা গম্ভীর গলায় বললো, দাদা ডোন্ট ফরগেট ইউ আর অ্যাবোভ ফিফটি।
রঞ্জনা চলে যেতেই ডক্টর চৌধুরী আবার প্রশংসা করতে শুরু করেন, মেয়েটা এসে আমার লাইফের প্যাটার্নই পাল্টে দিয়েছে।
…রঞ্জনার ঘরেই টাইম পিস থাকে। অ্যালার্ম বাজলেই ও উঠে ডক্টর চৌধুরীর ঘরে যায়। দু একবার পাশে দাঁড়িয়ে ডাক দেয়, দাদা! দাদা।
একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
আবার ডাকে, দাদা। উঠুন। পাঁচটা বাজে।
তবুও ঘুম ভাঙে না ডক্টর চৌধুরীর। রঞ্জনা আরো একটু এগিয়ে যায়, একটু ঝুঁকে পড়ে ওঁর মাথায় হাত দিতে দিতে ডাকে, দাদা, উঠবেন না? অনেকক্ষণ অ্যালার্ম বেজে গেছে।
ডক্টর চৌধুরী একবার এক মুহূর্তের জন্য চোখ মেলেই চমকে ওঠেন, অ্যালার্ম বেজে গেছে?
হ্যাঁ দাদা।
ডক্টর চৌধুরী একটু পাশ ফিরে শুতে শুতেই জিজ্ঞাসা করেন, তুমি অনেকক্ষণ ডাকছ?
না, বেশিক্ষণ না।
উনি ওপাশ ফিরে আবার একটু ঘুমুতে চেষ্টা করেন কিন্তু রঞ্জনা ওঁর মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আবার ডাকে, দাদা, আর দেরি করবেন না।
একে রঞ্জনার ডাকাডাকি তার উপর চোখের উপর এমন আলো পড়ে যে ওঁকে উঠতেই হয়। উনি বাথরুমে ঢুকলেই রঞ্জনা আবার নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুমোয়। ডক্টর চৌধুরী বেরুবার সময় চাকরকে ডেকে দেন। ও দরজা বন্ধ করে দিয়েই দিনের কাজ শুরু করে। সাড়ে ছটা-পৌনে সাতটায় উনি মর্নিং ওয়াক করে ফিরে এসেই আবার বাথরুমে যান। স্নান সেরে বেরুতে না বেরুতেই চা হয়। রঞ্জনাও উঠে পড়ে।
চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে দুজনের গল্প হয়।
চৌধুরী বাড়ির গল্প, দেবব্রতর ছেলেবেলার গল্প, দিল্লির গল্প। কখনও কখনও বেনারসের গল্প, ওয়াশিংটনের গল্প, কায়রো মস্কোর গল্প।
আচ্ছা দাদা, আপনার এখানে বড় দাদুর ছবি দেখি, কিন্তু আপনার নিজের দাদুর কোনো ছবি তো দেখি না।
আমার দাদু বিশেষ সুবিধার লোক ছিলেন না। আমার দাদুর চাইতে বড় দাদুই আমাকে বেশি ভালোবাসতেন, আমিও ওঁকেই বেশি ভালোবাসতাম…
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তাছাড়া ওঁর জন্যই আমি একটু লেখাপড়া শিখতে পেরেছি। আমার নিজের দাদুর কাছে থাকলে আমার কিছুই হতো না।
লেখাপড়ার প্রতি বুঝি ওঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল না?
বিন্দুমাত্র না।
আপনারা আর আহিরীটোলায় যান না?
আমি দু তিনবার গিয়েছি। একবার কি দুবার দেবুকেও নিয়ে গেছি।
ওসব সম্পত্তি তো আপনাদেরই?
ঠিক জানি না। আমার মনে হয় দাদু সব কিছু বেচে দেন।
এখন ওখানে কারা থাকে?
খুব দূরসম্পর্কের কিছু আত্মীয় আর কিছু ভাড়াটে।
ডক্টর চৌধুরী যখন দেবব্রতর ছেলেবেলার গল্প করেন তখনই ভারি মজা হয়।
তখনও আমরা সিমলায়। দেবু খুব ছোট। বড় জোর পাঁচ-ছ বছরের হবে। পাশের বাড়ির একটা পাহাড়ি মেয়ের সঙ্গে ওর খুব ভাব ছিল। কিছুকাল পরে ওরা সিমলা থেকে চলে গেলে দেবুর কি কান্না।…
কেন?
ডক্টর চৌধুরী হাসেন, কেন আবার? ও ঐ মেয়েটিকে বিয়ে করবে বলে পাগল।
রঞ্জনাও হাসে। বলে, ঐ রকম একটা পাহাড়ি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলেই ভালো হতো।
ডক্টর চৌধুরী হাসতে হাসতে একটু আনমনা হয়ে কি যেন ভাবেন। আমাদের আহিরীটোলার বাড়িতে এক বুড়ি থাকতেন। আমি তাকে বুড়ি পিসিমা বলে ডাকতাম। প্রথম যখন দেবুকে নিয়ে আহিরীটোলার বাড়িতে যাই উনি ওকে দেখে বলেছিলেন ওর সুন্দরী শিক্ষিতা ও বিদেশিনীর সঙ্গে বিয়ে হবে।
রঞ্জনা বললো, কই বিদেশিনীর সঙ্গে তো বিয়ে হলো না?
জ্যোতিষ আমি বিশ্বাস না করলেও মাঝে মাঝে বুড়ি পিসিমার কথাটা মনে হতো। বিশেষ করে ওকে লন্ডনে পাঠাবার পর একটু বেশি মনে হতো…।
রঞ্জনা হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে, আপনার ভাই ওখানে কাউকে বিয়ে করে রেখে আসেনি তো?
ডক্টর চৌধুরী বেশ গর্বের সঙ্গেই জবাব দেন, ভুলে যেও না ও দেবব্রত চৌধুরী।
একটু নীরবতা।
জান রঞ্জনা, বুড়ি পিসিমা ঠিকই বলেছিলেন। একদিক দিয়ে তুমিও তো বিদেশিনী।