হ্যাঁ। তাছাড়া আমাদের বাড়িতে খুব আসা-যাওয়া ছিল।
খুব ঘনিষ্ঠতা না থাকলে নিশ্চয়ই আপনার এখানে উঠতেন না।
এক কালে খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল তবে ইদানীং বেশ কয়েক বছর দেখাশুনা নেই।
দুই বন্ধুই শুধু আসছেন?
ওঁরা কেউই বিয়ে করেননি…
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তাছাড়া দুজনেই একই কলেজে লেকচারার।
তাই দুই বন্ধু বেড়াতে বেরিয়েছেন।
ওঁরা খুব ঘুরে বেড়ান।
খুব স্বাভাবিক। সংসারধর্ম না করলে কিছু নিয়ে তো থাকতে হবে।
আমিও তো বিয়ে করিনি; আমি কি নিয়ে আছি? প্রশ্ন করেই রমার দিকে তাকালাম।
আপনার বিয়ে করার সময় তো চলে যায়নি।
চলে যায়নি?
না।
দেড়টা-দুটোর মধ্যে সমস্ত রান্না শেষ করার পর আমি আর রমা একসঙ্গে খেতে বসলাম। খেতে খেতে ও জিজ্ঞাসা করল, আমি যদি এখন দিল্লিতে না থাকতাম তাহলে কাকে দিয়ে রান্না বান্না করাতেন?
আমি হাসলাম। বললাম, ভয় নেই। অন্য কোনো সুন্দরী যুবতী এখানে আসে না, আনিও না।
রমা আর কোনো কথা বলল না। চুপ করে রইল।
আমি বললাম, তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই এভাবে বিরক্ত করার অধিকার আমি পাইনি।
মুখ নিচু করেই বললো, আমিও আর কারুর হুকুম তামিল করি না।
তা আমি জানি।
কিন্তু এ অধিকার আমি কেমন করে পেলাম?রমা দিল কেন?রমাইবা কোনো অধিকারে আমাকে টেলিফোন করে বলতো, ওয়েস্টনগর থেকে আমার দুই বন্ধু দুপুরে আমাদের এখানে আসবে, খাবে। তারপর আমরা তিনজনে প্লাজায় সিনেমা দেখব। আপনাকে ওদের পৌঁছে দিতে হবে।
আমার সঙ্গে দুটি সুন্দরী মেয়েকে ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হবে?
ছেড়ে দিলেও আপনার দ্বারা কিছু হবে না, তা আমি জানি।
জান?
নিশ্চয়ই জানি। তবে আজ তো আমিও সঙ্গে থাকব। সিনেমা দেখে আমি কি একলা বাড়ি ফিরব?
আমি শুধু ড্রাইভারী করব নাকি আমারও একটা টিকিট কাটবে?
ওদের সঙ্গে আপনার সিনেমায় যেতে হবে না। পরে আমি আর আপনি একদিন দেখব।
সিনেমায় অনেকবারই আমরা গেছি। অনেক সময় জয়ন্তী বৌদি আমাদের সঙ্গে গিয়েছেন। সিনেমা দেখে বেরুবার সময় গাড়ির ল খুলতে গেলেই ও বলতো, এখনই বাড়ি যাবেন? একটু কফি-টফি খাওয়াবেন না?
জয়ন্তী বৌদি আমাদের সঙ্গে থাকলে সঙ্গে সঙ্গে বলতেন, ও সিনেমা দেখাল, আবার কফি খাওয়াবে কেন? বরং আমিই…
তুমি ক্ষেপেছ মা? উনি থাকতে তোমার পয়সায় কফি খাব?
আমি হাসি। জিজ্ঞাসা করি, এই রকম হ্যাংলামি করে কফি খেতে তোমার লজ্জা করে না?
ঠোঁট উল্টে, মাথা নাড়তে নাড়তে রমা বলতো, আপনার কাছে চাইতে আবার লজ্জা কিসের?
.
প্রত্যেক মাসেই সুভাষদা বাড়িতে দুটো-একটা পার্টি দিতেন।
প্রায় সব পার্টিতে আমি যেতাম। রমা দিল্লিতে থাকলে আমাকে সকালের দিকে টেলিফোন করে বলতো, আজ আপনি সেই সিল্কের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে আসবেন তো?
ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আসব কেন? বরযাত্রী যাব নাকি?
ইয়ার্কি না, সত্যি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আসবেন।
কেন?
বাবাদের ফরেন সার্ভিসের দুই বাঙালি সাহেব আসবেন…
তাতে কি হলো?
ওদের সাহেবীয়ানা দেখলে আমার গা জ্বলে যায়। তাইতো ওরা এলেই বাবাকে ধুতি-পাঞ্জাবি আর মাকে লাল পেড়ে গরদের শাড়ি পরাই।
আর তুমি?
আর আমিও খুব সাধারণ তাঁতের শাড়ি পরি।
সত্যি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আসব?
অব কোর্স!
.
বসে বসে আরো কত কি মনে পড়ল। এতকাল অনেকগুলো টুকরো টুকরো ঘটনা একসঙ্গে দেখতে গিয়ে, বিচার করে মনের মধ্যে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। সন্দেহ হচ্ছে ও হয়তো সত্যই আমাকে ভালোবাসত, আমাকে চাইত, আমাকে নিয়ে আগামী দিনের মিষ্টি-মধুর স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এতো আমার শুধু সন্দেহ। অনুমান। আবছা ধারণা। ও কি প্রত্যাশা করেছিল আমি নিজেই এগিয়ে যাব? অনুরোধ করব বা দাবি করব, রমা, তুমি আমার। আর কাউকে বিলিয়ে দিও না, দেবে না।
রাধাকিষণের তাগিদে আর বসে বসে ভাবতে পারলাম না। উঠে পড়লাম।
পরের দিন সকালেই প্রেসিডেন্ট টিটো চলে গেলেন। কাজকর্ম শেষ করে দুপুরের দিকেই আমি বাড়ি এলাম। খেলাম। মুলকরাজ আনন্দের কুলিপড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লাম।কদিন খুব পরিশ্রম গেছে বলে রাধাকিষণ আমাকে ডাকেনি, চাও দেয়নি। ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যা ঘুরে যাবার পর। তখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। চা খেতে খেতে রাধাকিষণকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ বেলায় কি রান্না করছ?
এ বেলায় রান্না করিনি।
বেশ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন?
তিন মূর্তি লেনের মেমসাব টেলিফোন করে বললেন, আপনি ওখানে খানা খাবেন…
তোমাকে বললেই আমি খেতে যাব?
উনি দুবার টেলিফোন করেছেন…
আমাকে ডাকলে না কেন?
আমি ডাকতে চেয়েছিলাম কিন্তু ঘুম ভাঙাতে মানা করলেন।
আমি বিছানার উপরেই চুপ করে বসে রইলাম। রাধাকিষণও পাশে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ পরে ও জিজ্ঞাসা করল, সাব খানা বানাব?
ওর কথার সোজাসুজি জবাব না দিয়ে বললাম, ও ঘর থেকে টেলিফোনটা নিয়ে এসো।
রাধাকিষণ টেলিফোন আনতেই ডায়াল ঘুরালাম। ডক্টর চৌধুরী বা রঞ্জনা নয় ওদের চাকরই টেলিফোনটা ধরল। জিজ্ঞাসা করলাম, সাব হ্যায়?
হায় মাগার বাথরুম গ্যয়া।
নায়া মেমসাহেব কাহা?
আপ হোল্ড কিজিয়ে।
দুএক মিনিট পরে রঞ্জনা টেলিফোন ধরতেই জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি টেলিফোন করেছিলে?
একবার নয় দুবার?
কি ব্যাপার?
আজ রাত্রে আপনি আমাদের এখানে খাবেন।
হঠাৎ কি ব্যাপার?
কি আবার ব্যাপার?আমি এসেছি, তাই দাদা বললেন আপনাকে যেন আজ রাত্রে খেতে বলি।