আজই ওঁর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনে দেখা হলো।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
কিছু বললেন?
না। কথা বলার সময় ছিল না। দেবব্রতর কি খবর?
ভালোই।
ব্যাঙ্গালোরে কেমন লাগছে?
ওখানেও তো সারাদিন একলা কাটাতে হয়।
আমি হাসলাম, তুমি কি আশা করেছিলে বিয়ের পর স্বামী তোমার কাছে সারাদিন কাটাবে?
আমি বুঝি তাই বললাম?
আমি তো সেই রকমই বুঝলাম।
আপনি সারা জীবনই আমাকে ভুল বুঝবেন। ওর গলার স্বরটা একটু অন্য রকম মনে হলো।
বোধহয় কথাটা শুনতে ভালোই লাগল, কি বললে রঞ্জনা?
কিছু না।
বল না কি বললে?
বললাম আপনি সব সময়ই আমাকে ভুল বোঝেন।
তার মানে? কবে আবার তোমাকে ভুল বুঝলাম?
যাক গে ওসব কথা। আপনি কেমন আছেন?
যেমন ছিলাম তেমনি আছি।
খাওয়া হয়েছে?
না। এক্ষুনি বাড়ি এলাম।
স্নান করেছেন?
তোমার টেলিফোন আসার এক মিনিট আগেই এসেছি।
তাহলে আর আপনাকে বিরক্ত করব না।
না, না, বিরক্ত হবার কি আছে! বরং এতদিন পরে তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালোই লাগছে।
বাজে বকবেন না। কথা বলতে ভালো লাগলে আপনিই আগে টেলিফোন করতেন।
ভালো না লাগলে কেউ এতক্ষণ ধরে কথা বলে?
সত্যি আপনাকে অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি। স্নান করতে যান।
ব্যস্ত হবার কিছু নেই!
না থাক। আপনি এবার স্নান করে কিছু খাওয়া-দাওয়া করুন। কাল আবার কথা হবে।
রঞ্জনা টেলিফোন ছেড়ে দিল। আমিও আস্তে আস্তে রিসিভার নামিয়ে রাখলাম কিন্তু স্নান করতে গেলাম না। বসে রইলাম। ভাবছিলাম রঞ্জনার কথা। আমার সম্পর্কে ওর মনের মধ্যে একটু অভিমান জমা আছে বুঝতে পারি, কিন্তু কেন? আমি কি অন্যায় করেছি? ভুল করেছি? ওর মনে কি কোনো দুঃখ, আঘাত দিয়েছি? কোনো প্রত্যাশা পূর্ণ করিনি? অনেকক্ষণ ধরে ভাবলাম কিন্তু কিছুতেই কোনো কূল-কিনারা পেলাম না।
রঞ্জনা যখন রমা ছিল তখনকার সমস্ত স্মৃতির খাতা খুলে হিসাব করতে বসলাম। সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের নয় কিন্তু লেনদেন যথেষ্ট হয়েছে। যখন তখন সব জমা-খরচের কথা মনে পড়ে না। মনে পড়তে পারে না। তবু চুপ করে বসে বসে মনে করার চেষ্টা করলাম। প্রথম থেকেই খুব সহজভাবে আমরা মিশেছি। পোড়া গরু সিঁদুর মেঘ দেখলে ভয় পায়। আমিও পেতাম বলে কোনো মেয়ের সঙ্গেই প্রাণ খুলে মিশতে পারিনি, পারব না কিন্তু ওর সঙ্গে মিশেছি। প্রাণ খুলে মিশেছি। ভালো লেগেছে। মনের অনেক ছোটখাট ক্ষত ঠিক হয়ে গেছে ওর সান্নিধ্যে, সংস্পর্শে। আরো কিছুদিন ওকে কাছে পেলে সব ক্ষত সেরে যেতো কিনা বলতে পারব না। তবে সম্ভাবনা ছিল না, একথা জোর করে বলার ক্ষমতা আমার নেই। হাজার হোক আমি রক্ত-মাংসের মানুষ, আমার হৃৎপিণ্ড ওঠানামা করে, সৌন্দর্য দেখতে ভালো লাগে, প্রিয়জনের সান্নিধ্যে আনন্দ পাই। পাথরের মতো আমি জড় পদার্থ হলে এসব অনুভূতি আমার থাকত না। রমার মতো শত সহস্ৰজনের সারা জীবনের সাধনাতেও আমার কোনো পরিবর্তন হতো না।
আমি জানি না রমার জন্য আমার কি পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু একথা ঠিক ওর অভাব অনুভব করি। ওর সঙ্গে আলাপ হবার পর থেকেই ওর উপর কিছু দাবি করার স্বাধীনতা আমার হয়। এ অধিকার আমি অর্জন করেছিলাম নাকি ও স্বেচ্ছায় আমাকে দিয়েছিল তা মনে নেই। বলতে পারব না।
.
হ্যালো!
কি ব্যাপার? এই সাত সকালে টেলিফোন করছ? টেলিফোনে আমার গলা শুনেই জয়ন্তী বৌদি জিজ্ঞাসা করলেন।
আজ রমাকে আমার সংসার সামলাতে হবে।
তোমার আবার সংসার?
হঠাৎ আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব এলে সংসার না করে কি উপায় আছে?
কেউ এসেছেন নাকি?
আমার দিদির কলেজ জীবনের দুই বান্ধবী আজ বিকেলের দিকে আগ্রা থেকে আসছেন কিন্তু এদিকে রাধা গিন্নী জ্বরে বেহুঁশ।…
একটু ধর। রমাকে ডেকে দিচ্ছি।
রমা টেলিফোন তুলেই বললো, কি ব্যাপার? এত সকালে আমাকে মনে পড়ল?
সব সময়ই তোমাকে মনে পড়ে কিন্তু জানাই না।
বাজে বকবেন না। বলুন কি ব্যাপার।
আজ বিকেলের দিকে আমার দিদির দুই বান্ধবী আগ্রা থেকে আসছে। কাল ভোরের বাসেই সিমলা চলে যাবেন। কিন্তু কাল থেকে রাধাকিষণের ভীষণ জ্বর।…
আমি আসব?
সেইজন্যেই তোমাকে টেলিফোন করছি।
আপনি এসে নিয়ে যাবেন নাকি বাবাকে বলব?
তুমি কতক্ষণে রেডি হবে বল; আমিই তোমাকে নিয়ে আসব।
আটটা নাগাদ আসুন।
ঠিক আছে।
আমি গাড়ি থেকে নামতেই সুভাষদা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার দিদির দুই বন্ধু আসছে?
আমি গাড়ি লক করতে করতে বললাম, হ্যাঁ।
ওরা তো আমার এখানেও থাকতে পারেন।
আমার ওখানে থাকার তো কোনো অসুবিধে নেই, শুধু রাধাকিষণের জ্বর হয়েই মুশকিল বাধিয়েছে।
রমা যখন যাচ্ছে তখন ও সব ব্যবস্থা করে দেবে। তোমায় কিছু ভাবতে হবে না।
তা জানি।
রমা তৈরিই ছিল। আমি এক কাপ চা খেয়েই ওকে নিয়ে রওনা হলাম। রওনা হবার আগে সুভাষদা আর বৌদিকে বললাম, রমার ফিরতে রাত হলে চিন্তা করবেন না ওদের খাওয়া-দাওয়া হবার পরই আমি ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।
বৌদি বললেন, তোমার অসুবিধে হলে টেলিফোন করো, ওকে পাঠিয়ে দেব।
না, না, দাদাকে আর কষ্ট করতে হবে না।
গাড়ি স্টার্ট করে শান্তি পথ ধরতেই বললাম, এই পথেই বাজার করে নিয়ে যাই, কি বল।
হ্যাঁ, সেই ভালো।
মাছ না মাংস কিনব বল তো।
ওঁরা কি পছন্দ করবেন তা আমি কি করে বলি বলুন।
দুরকম মাছ কেনার চাইতে মাছ-মাংস দুইই কেনা ভালো, তাই না?
তা তো বটেই।
একটু পরে রমা জিজ্ঞাসা করল, যারা আসছেন তারা আপনার দিদির সঙ্গে পড়তেন বুঝি?