কেন, কি হলো?
দেবু আর রঞ্জনা চলে যাবার পর কোনো কাজেই ঠিক মন দিতে পারছি না।
আমি বললাম, বাড়ির নতুন বউ চলে গেলে বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
আজ সন্ধ্যার দিকে আপনি আসবেন?
আজ?
হ্যাঁ আজই। একটু গল্পগুজব করে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করা যাবে।
ডক্টর চৌধুরীর ব্যর্থতার জন্য গিয়েছিলাম, না যেয়ে পারিনি। অনেক গল্প হলো। ঘণ্টার পর ঘন্টা।
তাসখন্দ এয়ারপোর্টে ওকে দেখেই আমার ভালো লেগেছিল। কথাবার্তা বলার পর আবো ভালো লাগল।
আমি ডক্টর চৌধুরীকে সমর্থন জানাই, রঞ্জনা ভালো লাগার মতোই মেয়ে।
আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষা আর আধুনিকতার যত বেশি প্রসার হচ্ছে, মাধুর্য তত বেশি হারাচ্ছে, কিন্তু রঞ্জনা রিয়েলি একটা একসেপসন।
তা ঠিক।
এই কদিনের মধ্যেই ও যে কি ভাবে আমাদের আপন করে নিয়েছে তা কি বলব।
সন্ধ্যার পর পরই অফিস থেকে সোজা গিয়েছিলাম। আশা করেছিলাম গিয়েই এক কাপ চা পাব কিন্তু ডক্টর চৌধুরী আমাদের রমা, ওদের রঞ্জনার প্রশংসায় এমনই ভেসে গেলেন যে চাকরটাকে চা দেবার কথা বলতেও পারলেন না।
হাজার হোক সুভাষবাবু একজন সিনিয়র ডিপ্লোম্যাট। তার একমাত্র সন্তান নিশ্চয়ই খুব আদরে মানুষ হয়েছে কিন্তু তবুও এই মেয়েটি কিভাবে এত কাজের হলো, ভাবতে অবাক লাগে।
অনেক দিন হোস্টেলে কাটিয়েছে তো?
হোস্টেলে থেকে তো ছেলেমেয়েরা আরো বেশি আরামপ্রিয় হয়। এক কাপ চা পর্যন্ত তৈরি করে খেতে হয় না।
তা ঠিক।
সুভাষবাবু যদি এখানেই বরাবর থাকতেন তাহলে ছুটিতে বাড়ি এসেও রঞ্জনাকে সংসারের কিছু কাজকর্ম করতে হতো বা ছোট ভাইবোন থাকলে নিশ্চয়ই কিছু দায়দায়িত্ব নিতে হতো কিন্তু এর তো সে সব কিছুই করতে হয়নি…
আমি আবার সমর্থন জানাই ডক্টর চৌধুরীকে, না, সেসব ঝামেলা ওকে কোনোদিনই সহ্য করতে হয়নি।
ইনস্পাইট অব দ্যাট ও সংসারের সব রকম কাজ করতে পারে আর ছোটখাট খুঁটিনাটি কোনো কিছুই ওর দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে না।
নো ডাউট সী ইজ এ নাইস গার্ল।
আমার মন্তব্য ওর কানেই পৌঁছল না। উড ইউ বিলিভ ইট ইফ আই সে যে ও রোজ আমার দুটো ফাউন্টেন পেনে কালি ভরে দিতে পর্যন্ত ভুলে যায় না।
খাওয়ার সময়ও অনেক কথা হলো। শেষে বললেন, আপনার সঙ্গে তো রঞ্জনা বা ওর বাবা মার খুব ঘনিষ্ঠতা। সুতরাং ইউ আর অলসোপার্ট অব আওয়ার বিগার ফ্যামিলী।
আমি হাসলাম।
না, না, হাসি নয়। আপনি নিয়মিত আসবেন। না এলে দুঃখ পাব।
আসব।
রেগুলার আসবেন আর এখানে এলেই খাওয়া-দাওয়া করে যাবেন।
আসব ঠিকই তবে সব সময় খাওয়া-দাওয়া করা বোধহয় সম্ভব হবে না।
ডক্টর চৌধুরী সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি জানালেন, সম্ভব হবে না কেন? আপনি তো এখানে একাই থাকেন?
একাই থাকি তবে চাকর আছে।
উনি যেন আমার কথাটা শুনতেই পেলেন না, এইতো সেদিন রঞ্জনা বলছিল ও রান্না না করলে আপনার খাওয়াই হতো না।
ডক্টর চৌধুরী বললেও নানারকম কাজকর্মের ঝামেলায় ওঁর ওখানে যেতে পারলাম না অনেকদিন। এর মধ্যে দু তিনদিন ওঁকে টেলিফোন করেছি। পাইনি। প্ল্যানিং কমিশনের অ্যাডভাইসার বলে ওঁকে সারা দেশ ঘুরে বেড়াতে হয়। মাস তিনেক পরে হঠাৎ রঞ্জনার একটা চিঠি পেলাম, তিন তারিখে আমরা দুজনেই মাদ্রাজ যাচ্ছি। একদিন ওখানে থাকব। তারপর পাঁচই ডিলক্স। এক্সপ্রেসে আমি দিল্লি রওনা হচ্ছি। মাসখানেক দাদার কাছে থাকব। আপনি নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবেন।
সাত তারিখ সকালে দু তিনবার নয়া দিল্লি স্টেশনে ফোন করে মাদ্রাজ ডিলক্সের খবর নিলাম। ভাবলাম স্টেশনে যাই কিন্তু গেলাম না। মনে হলো রঞ্জনা সম্পর্কে আমার অতটা উৎসাহ বা আগ্রহ। থাকা ঠিক নয়। অন্যায়। তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া করে বেরুবার সময় রাধাকিষণকে বললাম, কেউ আমার খোঁজ করলে বলল আমি এখানে ছিলাম না। আজ দুপুরেই এসেছি।
জী সাব।
যদি খুব দরকারি টেলিফোন আসে তাহলে অফিসে টেলিফোন করতে বলল।
কোন কারণ নেই, যুক্তি নেই, দাবি নেই কিন্তু তবুও একটা প্রত্যাশায় সারাটা দিন কাটালাম। সন্ধ্যা, রাত্রিও। এলো না। কয়েকবার টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল ঘুরাতে গিয়েও পিছিয়ে এসেছি। করিনি। পরের দিন সকালে মার্শাল টিটো দিল্লি এলেন। সারাটা দিন আমি অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে কাটালাম। যুগোশ্লাভ অ্যাম্বাসেডরের রিসেপসন অ্যাটেন্ড করে, নিউজ ডেসপ্যাঁচ করে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হলো। তার পরের দিনও ব্যস্ত রইলাম। তবে রাষ্ট্রপতি ভবনে ডক্টর চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হলো কিন্তু কোনো কথা হলো না। প্ল্যানিং মিনিস্টার, প্ল্যানিং কমিশনের মেম্বার ও অ্যাডভাইসাররা প্রেসিডেন্ট টিটোর সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন। তখন ডক্টর চৌধুরীর কথা বলার অবকাশ ছিল না। আমাকে দেখে শুধু একটু হাসলেন। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে চা খাচ্ছি এমন সময় টেলিফোন এলো। আমি হ্যালো বলতেই ওদিক থেকে রঞ্জনার গলা শুনতে পেলাম আপনার কি ব্যাপার বলুন তো?
কেন কি হলো?
আমার চিঠি পাননি?
পেয়েছি।
তবে কি?
একটা টেলিফোনও করলেন না?
কি দারুণ ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটছে তা তুমি ভাবতে পারবে না।
তাই বলে একবার টেলিফোনও করা যায় না?
ওসব কথা ছাড়ো। তুমি কেমন আছ?
ভালোই; তবে একলা একলা হাঁপিয়ে উঠছি।
কেন? দাদা বাড়ি নেই?
না। টিটো এসেছেন বলে কদিনই খুব ব্যস্ত।