প্রাইম মিনিস্টারের প্রোগ্রাম চেঞ্জ হওয়ায় আমরা সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, হোয়াই দিস চেঞ্জ, স্যার?
নেহরু হাসতে হাসতে বললেন, ভয় নেই, নট সাইনিং এনি এগ্রিমেন্ট উইথ পাকিস্তান অ্যাবাউট কাশ্মীর।
আমরাও হাসলাম।
নেহরু এবার বললেন, কিছু বন্ধুবান্ধব দেখা করতে আসবেন বলেই পাঁচটার বদলে চারটার সময় স্টুডেন্টদের সঙ্গে মীট করব।
পনের বছর আগেকার কথা হলেও আমার সব কিছু স্পষ্ট মনে আছে। ভারি মজা হয়েছিল ঐ মিটিং-এ।
প্রথমে নেহরু একটা ছোট্ট বক্তৃতা দিলেন। কিছু উপদেশ। শেষে একটি অনুরোধ, তোমাদের অনেকেরই জ্ঞান, বুদ্ধি দেশের কাজে নিয়োজিত হলে ভারতবর্ষের অসংখ্য মানুষের কল্যাণ হবে। নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের একটু ক্ষতি স্বীকার করেও দেশে ফিরে যেতে অনুরোধ করব।
এরপর শুরু হলো ছাত্রদের প্রশ্ন, নেহরুর উত্তর। নানা বিষয়ে নানা প্রশ্ন। দু চারজন ছাত্রছাত্রী অভিযোগ করলেন, অনেকেই দেশে গিয়ে চাকরি না পেয়ে ফিরে এসেছেন।
নেহরু বললেন, সবাইকে চাকরি দেবার ক্ষমতা আমাদের নেই। তবে ইন্ডিয়া ইজ ভেরি ফাস্ট ডেভলপিং ইন্টু এ মডার্ন নেশন এবং সেজন্য সায়েন্স অ্যান্ড টেকনলজির ছাত্রদের আমাদের বেশি দরকার।
সঙ্গে সঙ্গে একটি ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে বললো, মিঃ প্রাইম মিনিস্টার, একটি প্রশ্ন করতে পারি?
নেহরু হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, ইয়েস, মিঃ ইয়াংম্যান।
স্যার, আমি ইলেকট্রনিসের পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্স পড়ছি কিন্তু আমাদের দেশে ইলেকট্রনিক্সের বিশেষ উন্নতি হয়নি বলে আমরা অনেকেই বেশ চিন্তিত।
নেহরু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তোমরা চাকরি পাবেই কিন্তু বাইচান্স যদি না পাও তাহলে আই উইল অ্যাপয়েন্ট ইউ অ্যাজ মাই ইলেকট্রনিক্স অ্যাডভাইসার।
সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসি থামার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রটি আবার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আই অ্যাম সিওর ইউ উইল নট প্রমোট মী টু বী মিনিস্টার অব ইলেকট্রনিক্স।
আবার হাসি।
হাসতে হাসতেই নেহরু জবাব দিলেন, ভুল করে তোমাকে মন্ত্রী করলেও আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি প্রথম সুযোগেই তোমাকে ড্রপ করব।
হাসিতে ফেটে পড়লেন সবাই।
আরো কত জনের কত রকমের প্রশ্ন! লন্ডনের আবহাওয়াই এমন যে কেউই কিছু মনে করেন না।
স্যার, দেশে ফিরে যাবার সময় যদি বিদেশিনী স্ত্রীকে নিয়ে যাই?
চেয়ারে নয়, টেবিলের উপর বসে হাসতে হাসতে প্রাইম মিনিস্টার বললেন, যদি কেন, নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে কিন্তু সঙ্গে কিছু ফরেন এক্সচেঞ্জ আর স্কচের বোতল নিয়ে যেতে ভুল না। ইন্ডিয়াতে ও দুটোরই বড় অভাব।
হাসি।
স্যার! দশ বছর এখানে থাকার পর দেশে ফিরে গেলে সব শহরই নোংরা মনে হবে। আমাদের শহরগুলোর কি উন্নতি করা যায় না?
আমি সব কিছু করে গেলে তুমি প্রাইম মিনিস্টার হয়ে কি করবে?
হাসি।
স্যার। চিৎকার করল একটা ছেলে, ডু ইউ থিংক উই উইল গেট ব্যাক অকুপায়েড ক্যাশমীর?
ফিরে না পেলে ফিরিয়ে নেব।
সভার শেষে ছাত্রছাত্রীরা অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে প্রাইম মিনিস্টারকে ঘিরে ধরলেন। অটোগ্রাফ দিতে দিতে নেহরু টুকটাক ঠাট্টা করতে করতে হঠাৎ ইন্ডিয়ান হাই-কমিশনারের দিকে ফিরে বললেন, ক্যান ইউ ফাইন্ড আউট মাই ইলেকট্রনিক্স মিনিস্টার?
পনের বছর আগেকার কথা হলেও আমার সব কিছু মনে আছে। কিছু ভুলিনি। হাই কমিশনার নিজে খোঁজখবর করে ছেলেটিকে ভিড়ের মধ্যে থেকে নিয়ে এলেন প্রাইম মিনিস্টারের সামনে। প্রাইম মিনিস্টার ওর সঙ্গে দুটো-একটা কথা বলতে বলতে এগুতে গিয়ে সামনে কয়েকজন ফটোগ্রাফারকে দেখে বললেন, তোমাদের ক্যামেরায় কি ফিল্ম নেই যে, আমার ইলেকট্রনিক্স মিনিস্টারের সঙ্গেও আমার একটা ছবি তুলছ না?
পরের দিন লন্ডনের বহু মর্নিং পেপারেই এই ছবিটা ছাপা হয়েছিল। দিল্লিতে ফিরে আসার পর দেখেছিলাম, জেনেছিলাম ভারতবর্ষের নানা কাগজেও এই ছবি ছাপা হয়েছে।
.
দেবব্রত চৌধুরীকে সেই প্রথম দেখি কিন্তু সেদিন আলাপ হয়নি। সুযোগ হয়নি। তাছাড়া হাতে সময় ছিল না।
পরের দিন নেহরু দিল্লির পথে কায়রো রওনা হলেন। আমি গেলাম না, থেকে গেলাম। তিন চার দিন পরে এক সাংবাদিক বন্ধুর বাড়ি থেকে ফেরার পথে হোবর্ন টিউব স্টেশনে দেবব্রত চৌধুরীর সঙ্গে আমার দেখা। প্রথম সাক্ষাৎ পরিচয়। নেহরুর ঐ মিটিং-এ দূর থেকে ভালো লেগেছিল, সাক্ষাৎ পরিচয়ে আরো অনেক বেশি ভালো লাগল।
উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, লন্ডনে কতদিন থাকবেন?
বললাম, ইচ্ছে আছে আরো দিন পনের থাকার, তবে আগেও ফিরে যেতে পারি।
না না, আগে ফিরে যাবেন কেন? এত দূর দেশে এসে তাড়াতাড়ি ফিরে যাবার কোনো মানে হয় না।
তা ঠিক কিন্তু চাকরি আছে যে।
দেবব্রত চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন, জার্নালিজমের মতো সুখের চাকরি আছে নাকি?
আমি হাসলাম। টিউব স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বেশি তর্ক করা যায় না। আমি স্ট্রান্ড কন্টিনেন্টালে আছি। কাল বিকেলের দিকে আসুন গল্পগুজব করার পরে নিচের তলার ইন্ডিয়া ক্লাবের রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে মাছ-ভাত খাওয়া যাবে।
প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না আমার আমন্ত্রণ। আচ্ছা আসব।
আমি বললাম, গুড নাইট।
গুড নাইট।
.
নোট বই-পেন্সিল আর টাইপ রাইটার নিয়ে ঘুরছে কত শহর-নগর গ্রাম-গঞ্জ। ঘুরছি স্বদেশে বিদেশে। দেখছি কত মানুষ, মিশছি বহুজনের সঙ্গে। কাউকে ভালো লাগে, কাউকে লাগে না। টাইপ রাইটার খটখট করে নিউজ টাইপ করার সঙ্গে সঙ্গেই ভুলে যাই অধিকাংশ মানুষকে। সামান্য মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের স্মৃতি একটু বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় কিন্তু তারপর ভুলে যাই। মুছে যায় সব স্মৃতি। হঠাৎ কদাচিৎকখনও দু-একজনের দেখা পাই যারা আকর্ষণ করে, মুগ্ধ করে। নেহরুর মিটিং-এ ওই কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেবব্রত চৌধুরী আমাকে মুগ্ধ করেছিল। অনেক ছেলে-মেয়ের বুদ্ধি থাকে, চালাক হয়, স্মার্ট হয় কিন্তু সব কিছু মিলিয়ে একটা মাধুর্য? আপন বৈশিষ্ট্য? বড় কম। সর্বত্রই। বিশেষ করে লন্ডন প্রবাসী ভারতীয় ছেলেমেয়েদের মধ্যে আরো কম।