তাছাড়া মানুষের মতো ঘনিষ্ঠতম, হৃদ্যতা ভালোবাসা বা তিক্ততারও একটা নির্দিষ্ট আয়ু আছে। মেয়াদ আছে। এই সংসারে, এই মাটির পৃথিবীতে কোন কিছুই তো চিরস্থায়ী নয়, চিরদিনের নয়। নদীর মতো মানুষের জীবনেও জোয়ার আসে, ভরিয়ে দেয় মন-প্রাণ, দুর করে অনেক দৈন্য কিন্তু তার স্থায়িত্ব কতটুকু? ভাটার টানে আবার সবকিছু চলে যায়। ফিরিয়ে দিতে হয়। তা না হলে হিসাবের খাতায় মিল হবে কি করে? শুধু আসবে, আমদানি হবে, কিছুই ফিরে যাবে না, রফতানি হবে না? তাই কি কখনও হয়?
প্রেসিডেন্টের ট্যুর কভার করতে গিয়ে সুভাষদা, জয়ন্তী বৌদির সঙ্গে একটু বেশি হৃদ্যতা হয়ে গেছে। রমার সঙ্গে একটু অদ্ভুত ধরনের বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। সামাজিক অনুশাসন বা নিজেদের কোনো দৈন্য বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখেও অনেক কাছে এসেছি দুজনে।
.
ডাইনিং টেবিলে আমার সামনের দিকে বসে রমা জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনি তো অনেকবার বাইরে গিয়েছেন, তাই না? ।
হ্যাঁ গিয়েছি।
আমাদের অনেক ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনার আলাপ হয়েছে বা আছে?
সে তো খুব স্বাভাবিক।
অনেকের সঙ্গেই কি আপনার ঘনিষ্ঠতা?
অনেকের সঙ্গে কি ঘনিষ্ঠতা হয়?
তাহলে বাবার সঙ্গে এত ভাব হলো কেন?
বোধহয় উই লাইকড ইচ আদার।
আর মার সঙ্গে?
ঐ একই কারণে।
আমার সঙ্গে?
তোমার সঙ্গে আবার ঘনিষ্ঠতা হলো কোথায়?
পারহ্যাপস ইউ আর রাইট। মেলামেশা করলেও ঠিক ঘনিষ্ঠ হতে আপনি চান না, তাই না?
আমি কি চাই, তা তো তুমি বলবে।
রমা হাসতে হাসতে বললো, আপনি শুধু আবির দিয়ে হোলি খেলতে চান, রঙ মাখতে চান না।
শুধু আবির দিয়ে হোলি খেলেছি নাকি রঙও মেখেছি। তা ঠিক বুঝতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয় রঙও মেখেছি। আবার কখনও কখনও মনে হয় হোলিই খেলিনি। রমা কি হোলি খেলেছিল? রঙ মেখেছিল সর্বাঙ্গে? নাকি শুধু মুখেই একটু আবির মেখেছিল?
এসব প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারব না, নিতেও পারব না। অনুত্তরই থেকে যাবে। তবু মনের মধ্যে এসব প্রশ্ন উঁকি দেয়। বেশিদিন চেপে রাখতে পারি না। একটা অস্বস্তি, জ্বালা বোধ করি মনের মধ্যে। মনে হয় রমাকে একবার কাছে পেলেও বোধহয় একটু ভালো লাগত। শান্তি পেতাম। অনেকবার ভেবেছি যাই, ওদের খোঁজ করি, দেখি ওরা আছে কিনা। থাকলে একটু কথা বলব, গল্প। করব। একটু হাসব। দেখব ওর হাসি, সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত মখখানা…কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাইনি, যেতে পারিনি।
.
দিন পনের পর সন্ধ্যার পর অফিস থেকে ফিরে দেখি দেবব্রত আর রঞ্জনা বাড়ির সামনে গাড়িতে বসে আছে। আমাকে দেখেই ওরা গাড়ি থেকে নামল। দুজনকেই একবার দেখে নিয়ে দেবব্রতকে জিজ্ঞাসা করলাম, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন বুঝি?
বেশিক্ষণ নয়, বড় জোর মিনিট দশেক।
বুঝলাম, অনুমান করলাম তারও বেশি সময় অপেক্ষা করছে কিন্তু খেয়াল নেই। নতুন বিয়ের পর সময় যেন হাওয়ায় উড়ে যায়। ঘড়ির কাটা আর মনের কাটা একই গতিতে ঘোরে না।
আই অ্যাম রিয়েলি ভেরী সরি!
দেবব্রত বললো, এর জন্য দুঃখ করার কি আছে?
রঞ্জনা জিজ্ঞাসা করল, আপনার চাকরটা কোথায়?
ছুটিতে।
তিনজনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। রঞ্জনা জিজ্ঞাসা করল, আপনার খাওয়া-দাওয়ার কি হচ্ছে?
তালা খুলতে খুলতে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, দেখে কি মনে হচ্ছে অনশন করছি?
এই বুঝি আমার প্রশ্নের জবাব হলো?
দরজা খুলে আলোপাখার সুইচ অন করলাম। জানালাগুলো খুলে দিলাম। এক মিনিট।
আমি কিচেনে গিয়ে চায়ের জল চাপিয়ে ফ্রিজ আর কাপবোর্ড খুলে দেখছিলাম ওদের খেতে দেবার কিছু আছে নাকি। একটাও ডিম পেলাম না। পেলাম শুধু কিছু নাটস আর একটা কেকের অর্ধেক। একটা প্লেটে নাটসগুলো ঢালছি এমন সময় পিছন থেকে রঞ্জনার কথা শুনে চমকে উঠলাম, আপনি এসব কি করছেন?
বাপরে বাপ! এমন করে কেউ চমকে দেয়?
আমাদের বসিয়ে আপনি এসব কি করছেন?
বিশেষ কিছুই না, শুধু চা।
কোনো দরকার ছিল না।
তোমাদের দরকার না থাকলেও আমার মর্যাদা আর মানসিক শান্তির জন্য দরকার আছে।
রঞ্জনা এবার বললো, চা চিনি দুধ কই?
আমি কোনো কথা না বলে সব কিছু এগিয়ে দিতেই ও বললো, আপনি যান, আমি নিয়ে আসছি।
আমি দেবব্রতর কাছে এসে বসলাম। কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, নৈনিতাল গিয়েছিলাম প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটু কৈফিয়ত দিল, যেতে চাইনি কিন্তু দাদা জোর করে পাঠালেন।
ভালোই করেছে। নিজেদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং হবার জন্য এই সময় একটু বাইরে যাওয়া ভালো।
রঞ্জনা চা, নাটস কেক নিয়ে এলো। আমাদের দিল। ও নিজেও নিল।
একটু লজ্জিত হয়েই বললাম, প্রথম দিন আপনারা এলেন অথচ কিছুই অফার করতে পারলাম না বলে…
দেবব্রত বললো, এখন আবার কি অফার করবেন?
রঞ্জনা জিজ্ঞাসা করল, আপনি হঠাৎ এত ফর্মাল হয়ে গিয়েছেন কেন বলুন তো?
বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে তোমার ও দেবব্রতবাবুর একটা নতুন মর্যাদা হয়েছে আমি তার অমর্যাদা। করতে পারি না।
আমার কথায় ওরা দুজনেই হাসল।
চা খেতে খেতে নানা কথা হলো।
রঞ্জনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার বাবা-মার চিঠি পেয়েছ?
পৌঁছোনোর সংবাদের টেলিগ্রাম ছাড়া মার দুটো বাবার একটা চিঠি এসেছে।
তুমি চিঠি দিয়েছ?
দিয়েছি। আপনি ওঁদের কোনো চিঠি পাননি?
তোমার মার একটা চিঠি পেয়েছি।