দেবব্রত হাসল, মা আপনাকেও মারবেন না, আমারও নিন্দা করবেন না।
দেবব্রত আর দাঁড়াল না, চলে গেল।
আচ্ছা বৌদি, আজকালকার কোনো ছেলে এমন সুন্দর করে মা ডাকবে?
সত্যি বলছি ওর মা ডাকটা শুনতে আমার ভীষণ ভালো লাগছে।
সুভাষদা বললেন, ওর মা ডাক শুনেই বোঝা যায় হাউ ইনোসেন্ট হি ইজ।
হাজার হোক ডক্টর দেবতোষ চৌধুরীর ভাইয়ের বিয়ে। প্রেসিডেন্ট বা প্রাইম মিনিস্টার না এলেও অনেক ভি-আই-পি এসেছিলেন। এসেছিলেন অনেক গণ্যমান্য বরেণ্য অতিথি। আস্তে আস্তে সবাই চলে গেলেন। প্যান্ডেল ফাঁকা হলো। মোটর গাড়ির হর্নের আওয়াজ বন্ধ হলো। ভাটা পড়ল ক্যাটারারদের কর্মচাঞ্চল্যে। ডক্টর চৌধুরী, দেবব্রত, সুভাষদা, বৌদির কাছ থেকে ছুটি নিয়ে ভিতরের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, রঞ্জনা, আমি যাচ্ছি।
রমা হাসল, আপনিও রঞ্জনা বলছেন?
রমাই তো রঞ্জিত হয়ে রঞ্জনা হলো।
ও হাসল।
আমি যাচ্ছি।
এক্ষুনি?
হ্যাঁ।
এত তাড়াতাড়ি?
তাড়াতাড়ি কোথায়? নটা বাজে।
তাতে কি হলো?
সাড়ে পাঁচটায় এসেছি। এখনও যাব না?
রিসেপসনের সময় ছিল ছটা থেকে সাড়ে সাতটা। আটটা পর্যন্ত অনেকেই ছিলেন। রঞ্জনা তাই কিছু বলতে পারল না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এমন সময় দেবব্রত এলো। বললাম, টেলিফোন করবেন।
নিশ্চয়ই।
আমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্যান্ডেল পার হয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাবার সময়ই দেবব্রত এসে হাজির। আপনি কিছু খেলেন না?
আমি ওঁর কাঁধে একটা হাত রেখে বললাম, খেয়েছি।
আপনাকে তো কিছু খেতে আমি দেখিনি।
আমার যা খাবার আমি ঠিকই খেয়েছি।
না, আপনি আমাদের সঙ্গে খেয়ে যান।
সত্যি বলছি আমি খেয়েছি, এখন আর কিছু খাব না। আমি চলি।
রঞ্জনা বলছিল…
ওকে কথাটা বলতে না দিয়েই আমি বললাম, ওকে আপনি একটু বুঝিয়ে বললেই হবে। গুড নাইট।
গুড নাইট।
আমি গাড়ির দিকে এগুতেই দেবব্রত বাড়ির মধ্যে চলে গেল।
গাড়িতে স্টার্ট দিলাম কিন্তু ক্যাটারারের একটা টেম্পো সামনে থাকায় এগুতে পারছিলাম না। হঠাৎ দেবব্রত এসে হাজির, আপনাকে রঞ্জনা একটু ডাকছে।
আমাকে?
হ্যাঁ।
স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ি থেকে নামলাম। প্যান্ডেল পার হয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম। লিভিংরুমে বসে ডক্টর চৌধুরী সুভাষদাদের সঙ্গে গল্প করছিলেন। আমাকে ওঁরা দেখতে পেলেন না। আমি আরো এগিয়ে গেলাম।
কি ব্যাপার? তুমি আমাকে ডেকেছ?
হ্যাঁ।
কেন?
আপনি আমাদের সঙ্গে খাবেন।
কফি-টফি অনেক কিছু খেয়েছি। এখন আর কিছু খাব না।
দেবব্রত আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিল কিন্তু প্যান্ডেলের ওদিক থেকে কে যেন ডাকতেই চলে গেল।
খেয়ে যান। আমি খুব খুশী হব।
মনে মনে বললাম, তোমাকে খুশী করার দিন শেষ। কি হবে তোমাকে খুশী করে। আমি তোমার এই ছোট অনুরোধনা রাখলেও খুশীর বন্যায় তুমি ভেসে যাবে। ভীত সন্ত্রস্ত হরিণীর মতো যত সংশয়ই তোমার মধ্যে এখন থাক, সব দূর হয়ে যাবে। আসন্ন কালবৈশাখীতে তৃণখণ্ডের মতো আমাকে খুশী করার প্রবৃত্তি, মন উড়িয়ে নেবে।
কি হলো? কথা বলছেন না যে?
আমি একবার ওর দিকে চাইলাম, কাল ভোর সাড়ে ছটায় আমার ফ্লাইট, তা জান তো?
জানি।
চারটের সময় উঠতে হবে।
হোক। আপনি না খেয়ে যেতে পারবেন না।
পারব না?
না।
আমি হাসলাম।
হাসছেন কেন? বিয়ে হয়ে গেল বলে কি পর হয়ে গেলাম ভাবছেন?
আমি কিছুই ভাবছি না।
বিয়ে হোক আর যাই হোক, আমার কথা আপনাকে শুনতেই হবে।
.
এই পৃথিবীতে মানুষ কত কথা বলে। শৈশব থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। প্রয়োজনের কথা, ইচ্ছার কথা। কখনও কখনও মনের কথাও মানুষ বলে। কিন্তু কম। খুব কম। মানুষ প্রকাশ্যে অন্যের অবগতির জন্য যত কথা বলে তার চাইতে অনেক অনেক বেশি কথা বলে মনে মনে। আপন মনে। যে বক্তা, সেই শ্রোতা। কেন জানি না, সেদিন রাত্রে আমার মনে হলো, রমা, রঞ্জনা মনে মনে অনেক কথাই বললো আমাকে। আমি শুনতে পেলাম না কিন্তু কেমন করে যেন অনুভব করলাম। মনে মনে, হৃদয় দিয়ে। ওর মুখের ভাষা, চোখের ইঙ্গিত দেখে।
সপ্তাহখানেক পরে সুভাষদা আর বৌদি মস্কো ফিরে গেলেন। ডক্টর চৌধুরী, দেবব্রত, রঞ্জনা ও সুভাষদার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব এয়ারপোর্টে এসেছিলেন। আমিও ছিলাম। অনেক কথা, অনেক চোখের জল পড়ল। আমি রঞ্জনাকে বললাম, কাঁদছ কেন? হিন্দু ইউনিভার্সিটি থেকে এমএ পাস করে এবার দিল্লিতে ডক্টরেট পড়তে এসেছ আর রিসার্চ প্রজেক্ট হচ্ছে বাঙ্গালোরে…
কেউ কেউ হাসলেন। রঞ্জনা আমাকে বললো, আপনি চুপ করুন তো।
কিছুক্ষণ পরে সুভাষদার প্লেন ছাড়ল। আমরা সবাই আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম কয়েক মিনিট। তারপর আস্তে আস্তে রওনা হলাম বাড়ির দিকে। ডক্টর চৌধুরী আর দেবব্রত দুজনেই ওদের ওখানে যেতে অনুরোধ করলেন। বললাম, সময় পেলেই আসব।
সময় পেয়েছি অনেক দিন অনেক সময়। আমি যাইনি। দেবব্রত লম্বা ছুটি নিয়ে এসেছে। হয়তো ঘুরবে ফিরবে বেড়াবে। দিল্লিতে, দিল্লির বাইরে। হয়তো সিমলা পাহাড়ে বা আরো দুরে ডাল লেকে।
অথবা গুলমার্গের নিশ্চিন্ত প্রশান্ত পরিবেশে। কত নামকরা লোক ডক্টর চৌধুরীর বন্ধু ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। দেবব্রত আর রঞ্জনাকে নিয়ে তাদের কাছে যাবেন। তারাও আসবেন। এইসব নানা কিছু চিন্তা করে আমি যাইনি। আরো একটা কারণ ছিল। রঞ্জনা এখন শুধু সুভাষদার মেয়ে নয়, ডক্টর চৌধুরীর ভ্রাতৃবধু, দেবব্রতর স্ত্রী। আমি সাংবাদিক। বহু লোকের সঙ্গে আমার আলাপ, ঘনিষ্ঠতা। অনেকে খাতিরও করেন। কেউ কেউ ভালোবাসেন। কিন্তু ওদের মতো সামাজিক মর্যাদা আমার নেই। হবেনা। চাঁদের আলোর মতন সাংবাদিকদেরও নিজস্ব কোনো আলো নেই, পরের, ভি-আই পিদের সূর্য-কিরণেই উদ্ভাসিত। ছোটখাট সুক্ষ্ম আত্মসম্মানবোধ, সামাজিক কারণে আমি যাইনি। মস্কো থেকে বৌদির চিঠি এসেছে। রঞ্জনার খবর নিয়ে জানাতে বলেছেন। আমি রঞ্জনার খবর নিইনি, বৌদির চিঠিরও জবাব দিইনি। ভেবেছি কি দরকার বেশি উৎসাহী হবার। যতটুকু ঘনিষ্ঠতা আছে, সেই যথেষ্ট। আরো ঘনিষ্ঠ হবার প্রয়োজন নেই।