কিন্তু তোমার তো এ সমস্যার সমাধান হওয়া মুশকিল।
আপনি মাঝে মাঝে আসবেন।
মাঝে মাঝেই কি আসা সম্ভব?
আপনি তো বিয়ে করে সংসারে জড়িয়ে পড়েন নি যে দু এক দিনের জন্যও বেরুতে পারবেন!
বিয়ে না করলেই বুঝি ইচ্ছামতো আসা যায়?
নিশ্চয়ই যায়।
আমি মজা করে বললাম, তাহলে তো তুমিও মাঝে মাঝে দিল্লি আসতে পার।
আমি তো মেয়ে। তাছাড়া হোস্টেল থেকে আমাকে ছাড়বে নাকি? এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমি যখন ছুটিতে বাবা-মার কাছে যাব তখন এসে দেখবেন কত ঘুরতে পারি।
ওর প্রস্তাব শুনে হাসি পায়। বলি, তুমি ছুটিতে কায়রো-লন্ডন-মস্কো-ওয়াশিংটন যেতে পার বলে কি আমিও পারব?
আমি বলছিলাম যদি আসেন…
ঐ ইফস্ অ্যান্ড বাটগুলোই তো লাইফের সব চাইতে বড় সমস্যা।
তারপর রমা বলেছিল, বাবা দিল্লিতে এলে দেখবেন আপনাকে কি বিরক্তি করি।
হঠাৎ একজন মানুষের সঙ্গে আলাপ হতে পারে, ঘনিষ্ঠতা হতে পারে, ভালোবাসা হতে পারে কিন্তু কোনো কারণেই মুহূর্তের মধ্যে সেই পরিচিত, ভালোবাসার পাত্রপাত্রীকে মন থেকে মুছে ফেলা যায় না। আমি অনেকবার অনেক রকমভাবে চেষ্টা করেও রমার ঐ বুদ্ধিদীপ্ত মখখানা ভুলতে পারছিলাম না। পর পর কদিন নাইট শোতে সিনেমা গেলাম। সিনেমা হলে ঢুকলেই নিউজ রীল দেখতে হয়। দেখতে হলো। আরো অনেক কিছুর সঙ্গে বুদ্ধগয়া আর সারনাথে বুদ্ধ জয়ন্তী উৎসবও দেখাল। ভুলতে গিয়ে আবার সবকিছু নতুন করে মনে পড়ল।
আপনি তো জার্নালিস্ট। একদিন না একদিন কোনো না কোনো কারণে আপনাকে সারনাথে আসতেই হবে কিন্তু তখন কি মনে পড়বে আমার সঙ্গে একটা দিন কাটিয়েছিলেন?
ঐ নিউজ রীলের জন্য অর্ধেক সিনেমাটাই মন দিয়ে দেখতে পারলাম না।
বেনারসের মতো দিল্লিতেও যদি গঙ্গা থাকত তাহলে বেশ নৌকা চড়ে বেড়াতে পারতাম, তাই না?
কেন, গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াতে তোমার ভালো লাগে না?
লাগে কিন্তু নৌকা যখন মাঝ গঙ্গায় টলমল করে, তখন ভয়ও লাগে, মজাও লাগে।
নৌকা যখন বেশি দুলতে শুরু করত তখনই রমা দুহাত দিয়ে আমার একটা হাত চেপে ধরত। জিজ্ঞাসা করতাম, নৌকা ঘুরিয়ে নিতে বলব?
না, না, ঘুরিয়ে নেবে কেন?
তুমি ভয় পাচ্ছ যে!
একটু একটু ভয় পাচ্ছি ঠিকই কিন্তু আপনি তো আছে।
রাধাকিষণ খেতে ডাক দেয়। চটিটায় পা দিতে গেলেই আবার মনে পড়ে কায়রোতে রমাই পছন্দ করেছিল, এইটাই নিন। খুব সুন্দর মানাবে আপনাকে।
সুন্দর চটি পরলেই কি আমি সুন্দর হবো?
আপনাকে সুন্দর দেখতে বলে এত অহঙ্কার কেন?
তোমার কাছে আমি রূপের অহংকার করব?
মেয়েদের সৌন্দর্যের সঙ্গে পুরুষের সৌন্দর্যের তুলনা করার কোন মানে হয় না।
রমার কথা কেন এত মনে হয় তা জানি না। বুঝতে পারি না। কিন্তু হয়। হবেই। মাঝে মাঝেই হয়। বোধহয় মনের মধ্যে একটা শূন্যতা অনুভব করি। বোধহয় কেন? নিশ্চয়ই একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। মনে মনে বেদনাবোধ করি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই ভেবে সান্ত্বনা পাই যে দূরের অপরিচিত ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়নি।
তার চাইতে বড় কথা দেবব্রত চৌধুরীর সঙ্গে ওর বিয়ে হলো। কোনো না কোনো ভালো ছেলের সঙ্গেই রঞ্জনার বিয়ে হতো কিন্তু ভালোরও তো জাত আছে। দেবব্রত শুধু একটা ভালো ছেলে নয়, একটা স্বপ্ন, একটা সাধনা, একটা বিরাট সম্ভাবনা। ডক্টর চৌধুরীর রিসেপসনে সুভাষদাকে সেই কথাই বললাম।
একটু দাঁড়াও। আমি এক্ষুনি আসছি। সুভাষদা ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলেও একটু পরেই বৌদিকে নিয়ে ফিরে এলেন। বৌদিকে বললেন, শোন শোন ও কি বলছে।
বৌদি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি বলছ?
এবার আমি বললাম, সুভাষদাকে বলছিলাম দেবব্রতর মতো ছেলে হয় না।
সঙ্গে সঙ্গে সুভাষদা বললেন, না না, তুমি যে কথাগুলো আমাকে বললে, ঠিক সেই কথাগুলোই ওকে বলল।
বলছিলাম, দেবব্রত ইজ এ পিস অফ ড্রিম, একটা সাধনা, একটা বিরাট সম্ভাবনা।
বৌদি চট করে একবার সুভাষদার দিকে তাকিয়ে আমাকে বললেন, দেবুকে দেখে তো খুবই ভালো মনে হয়।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, গিল্টি সোনার গহনা দেখতেও তো ভালো লাগে কিন্তু দেবু পাকা সোনা।
আনন্দে খুশীতে ওঁরা নীরব হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন।
সত্যি বলছি বৌদি, এমন ভালো ছেলে আমি খুব কম দেখেছি।
হাজার হোক একটি মাত্র সন্তান। রমাকে ওরা অত্যন্ত বেশি ভালোবাসেন। সারা জীবন ফরেন সার্ভিসে কাটিয়েও সুভাষদা ওকে নিছক সুন্দর একটা বাঙালি মেয়ে তৈরি করেছেন। একমাত্র সন্তানকে ছেড়ে থাকতে অত্যন্ত কষ্ট হলেও বেনারসে রেখে পড়িয়েছে। মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে ওঁরা অত্যন্ত চিন্তিত ছিলেন। আমার কথা শুনে ওঁরা দুজনেই শুধু খুশী নন, নিশ্চিন্ত হলেন।
দেবব্রত পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের তিনজনকে দেখে একটু থমকে দাঁড়াল। আমি ওকে বললাম, আপনাকে দেখে আমার ঈর্ষা হচ্ছে।
দেবব্রত জিজ্ঞাসা করল, কেন?
ভালো স্ত্রী অনেকেই পায়, কিন্তু ভালো শ্বশুর-শাশুড়ি পাওয়া সত্যি ভাগ্যের দরকার।
দেবব্রত জবাব দেবার আগেই বৌদি বললেন, না না। তোমার মতো জামাই পেয়েছি বলে আমরাই ভাগ্যবান।
দেবব্রত বললো, না মা, ওকথা বলবেন না।
আমি ঠাট্টা করে বললাম, দু মিনিট আগেই বৌদি বলছিলেন জামাইটা ঠিক মনের মতো হলো না।
সত্যি সত্যি ডান হাতটা তুলে বৌদি বললেন, একটা চড় খাবে।