পাঠাবেন না? তোমার যখন ছেলেমেয়ে হবে তখন বুঝবে…
রমা হাসল। আমাকে একবার ভালো করে দেখল। আপনি জার্নালিস্ট বলে বড় পাকা পাকা কথা বলেন।
হাজার হোক আমি তোমার বাবা-মার বন্ধু। এসব কথা বলার অধিকার আমার আছে বৈকি।
হঠাৎ রমা বললো, বাবা-মার বন্ধু হয়েই তো আপনি আমাকে মুশকিলে ফেলেছেন।
তার মানে?
রমা কিছুতেই মনের কথা খুলে বললো না। অনেক অনুরোধ করলাম।না, তবুও না। আজ পর্যন্ত রমা আমাকে সে কথা বলেনি। মনে হয় আর কোনোদিনই বলবে না। কেননা বাছ-বিচার না করেই মানুষের রোগ হয়। ধনী-দরিদ্র, ছেলেবুড়ো, শহুরে বাবু, গ্রামের চাষি। সবার স্বপ্ন দেখার মধ্যেও কোনো বাছবিচার নেই। সবাই দেখতে পারে। কোনো বাধা নেই। রমা কোনো বেহিসেবী স্বপ্ন দেখেনি তো? জানি না। কোনো গুণ না থাকলেও প্রাণ চঞ্চল কাঠবেড়ালীকে সবার ভালো লাগে। রমার ভালো লাগেনি তো? রমা রঞ্জনা হলো। আমি খুব খুশী। নিশ্চিন্ত। নানা কারণে মনে যে স্মৃতির। পলিমাটি পড়ে আছে, তার ওপর অনেক বেদনা-বিধুর স্বপ্ন জন্ম নিয়েছে। কোনো মানুষই তো শুধু দায়িত্ব-কর্তব্য, খাওয়া-পরা নিয়েই বেঁচে থাকে না। আমিও না। মনের মধ্যে কিছু স্বপ্ন সবারই জমা থাকে। আমারও আছে। বাইরে আমার যত দৈন্যই থাক, মনে মনে আমি সম্রাট। কোনো কিছুর বিনিময়েই সে সাম্রাজ্য বিলিয়ে দেওয়া যায় না।
যুক্তি, তর্ক, সামাজিকবোধ দিয়ে নিজেকে অনেক সংযত করলেও একটা বিষণ্ণ করুণ সুর মাঝে মাঝেই নিজের মধ্যে শুনতে পাচ্ছিলাম। সুভাষদাদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হবার আগের মতো। দিনগুলো কাটাচ্ছিলাম। সারাদিন সংবাদ সংগ্রহের তাগিদে ঘুরে বেড়াই, টাইপরাইটার খটখট করি, টেলিপ্রিন্টার-টেলেক্স অপারেটরকে গছিয়ে দিয়েই চলে যাই চাণক্যপুরীর কোনো না কোনো ডিপ্লোম্যাটিক পার্টিতে। রাত নটা-দশটা বা এগারোটা বারোটায় বাড়ি ফিরি। রাধাকিষণের সেবা উপভোগ করে শুয়ে পড়ি। কোনোদিন কোনো কারণে কোনো পার্টিতে না গেলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরি। চাকফি খেয়ে লরেন্স ডুরেলের ডিপ্লোম্যাটিক জীবনের পটভূমিকায় লেখা স্পিরিট দ্য কোর বা স্টিফ আপার লিপ নিয়ে মজার মজার ঘটনাগুলো আবার পড়ি। কখনও বা শরৎচন্দ্রকেই পড়তে শুরু করি নতুন করে। বেশি ক্লান্ত থাকলে পড়ি না, পড়তে ইচ্ছা করে না। রাধাকিষণের সঙ্গেই গল্প করি।
হ্যাঁরে, একবার তোর বৌ-ছেলেদের দিল্লি দেখাবি না?
দিল তো করে মাগার…
মাগার কি হলো?
অনেক খরচা সাব।
তুই তো শুধু ট্রেন ভাড়া দিয়ে আনবি। থাকা-খাওয়ার তো খরচ লাগবে না।
রাধাকিষণ একটু কাচুমাচু করে বললো, তাছাড়া দিল্লির মতো ইতনা বড় শহরে আসতে বিবির খুব ডর।
আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলাম, ভয় কিসের?
ওরা তো এত ভালো কোঠি, মোটর গাড়ি, টেলিফোন, ফ্রিজ, রেডিও–কিছুই দেখেনি…
তাহলে একবার আমিই তোর দেশে যাব।
গেলে তো সবাই খুব খুশী হবে মাগার আপনি আমাদের বাড়িতে থাকতে পারবেন না।
আমি কি কোটিপতি মহারাজা যে গ্রামে গিয়ে থাকতে পারব না?
রাধাকিষণের কাজ থাকে। বেশিক্ষণ গল্প করতে পারে না। চলে যায়। আমি একা বসে থাকি। নানা কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রমার কথা মনে হয়। অনেক কথা। বহু ছোটখাট ঘটনা।
প্রথমবার বেনারস গেছি ওর সঙ্গে দেখা করতে। হাজার হোক প্রথম দেখা, প্রথম আলাপ। প্রথমে একটু জড়তা, দ্বিধা থাকবেই। আমারও ছিল, ওরও ছিল। সেই দ্বিধা আর জড়তা যখন চলে গেল, তখন রমা হাসতে হাসতে বললো, আপনি আসার আগে আপনার সম্পর্কে দারুণ দুশ্চিন্তা ছিল।
দুশ্চিন্তা?
হ্যাঁ।
কেন?
মার চিঠি পড়ে আর আপনার ওয়াশিংটনের ছবিগুলো দেখে মনে মনে আপনার সম্পর্কে একটা ধারণা করেছিলাম কিন্তু ভয় ছিল যদি আমার ধারণা ঠিক না হয়? যদি আপনি খুব গম্ভীর প্রকৃতির, খুব সিরিয়াস মানুষ হন?…।
আরো কিছু ভেবেছিলে নাকি? আমি হাসতে হাসতে জানতে চাই।
আমি এখানে একলা একলা থাকি বলে বাবা-মার খুব চিন্তা হয়। অনেক সময়ই, অনেককে আমার খোঁজ-খবর নিতে পাঠান কিন্তু অধিকাংশ লোককেই আমার ভালো লাগে না।
ভাবলাম জিজ্ঞাসা করি, আমাকে ভালো লেগেছে? কিন্তু পারলাম না। জানতে চাইলাম, আমার সঙ্গে আলাপ করে এখন কি মনে হচ্ছে?
আই অ্যাম নট ডিসঅ্যাপয়েন্টেড।
আমার সম্পর্কে ওর কাছ থেকে আরো কিছু শোনার আগ্রহে জিজ্ঞাসা করলাম, তার মানে?
তার মানে আপনি আমাকে হতাশ করেননি।
পরের দিন রমাকে নিয়ে টাঙ্গায় চড়ে সারনাথ গেলাম। ঝাঁকুনি সামলাতে গিয়ে দু একবার ও আমার হাতটা চেপে ধরেছে। শুধু প্রয়োজনে নাকি তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার ইচ্ছাও ছিল, তা বুঝতে পারিনি। তবে ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে সাবলীলভাবে মেশার জন্য। সারনাথে ধর্মরাজিকা স্কুপের পাশে দুজনে পাশাপাশি বসে অনেকক্ষণ অনেক গল্প করলাম। শেষের দিকে হঠাৎ বললো, আপনি আসার জন্য দুটো দিন বেশ কেটে গেল। রোজ কলেজ আর হোস্টেল লাইফ বড় একঘেয়ে লাগে।
কোথাও বেড়াতে যাও না?
কোথায় যাব? দু
চার দিনের ছুটিতে আশে-পাশে কোথাও তোমরা বেড়াতে যাও না?
একে হিন্দু ইউনিভার্সিটি, তার উপর আমরা মেয়ে। অত ঘুরাঘুরির সুযোগ এখানে নেই। একটু থেমে আবার বললো, কাছাকাছি যাদের বাড়ি বা আত্মীয়স্বজন আছে তারা অবশ্য দুচার দিনের ছুটিতেও অনেক সময় ঘুরে আসে কিন্তু কলকাতায় দাদু-দিদা ছাড়া আমার তো কেউ কাছাকাছি থাকে না।