সুভাষদাদের সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য অতটা না হলেও যথেষ্ট। রমা আমার চাইতে কয়েক বছরের ছোট কিন্তু এমন ছোট নয় যে ও আমাকে কাকু বলতে পারে। আমি এমন বড় নই যে ওর বন্ধু হতে পারি না বা আমাদের দুজনের মনের মধ্যে একই সঙ্গে একটা ছোট্ট মিষ্টি স্বপ্ন দানা বাঁধতে পারে না। বিচ্ছিরি না হলেও বেশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতি ছিল। ওর বিয়ে হয়ে অন্তত এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে বেঁচেছি। রমাও নিশ্চয়ই স্বস্তি পেয়েছে।
রমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় বেনারসে। আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পরই বৌদি ওকে চিঠি দিয়েছিলেন। মনে হয় আমার সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো কথাই লিখেছিলেন। বৌদি আমাকেও জানান যে ওকে চিঠি দিয়েছেন। রমার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ থাকলেও দ্বিধা ছিল মনে মনে। তার অনেক কারণ ছিল। তবু গিয়েছিলাম। একবার কলকাতা যাবার পথে বেনারস ঘুরে গেলাম। বেশ লেগেছিল। একটি মিষ্টি স্মৃতির প্রলেপ লেগেছিল আমার মনে।
এরপর মাঝে মাঝেই ওর কথা মনে পড়ত। দুএকবার ওকে চিঠি লিখেছি। অতি সাধারণ মামুলি চিঠি। বোধহয় খামে ঠিকানাও টাইপ করেছি কিন্তু ডাক বাসে ফেলিনি। ভেবেছি কি দরকার। যে স্মৃতিটুকু বুকে নিয়ে বেঁচে আছি, সেইটুকুই থাক। অম্লান থাক। ঐ পুঁজিটুকু নিয়েই আমার দিন কেটে যাবে। আমি না লিখলেও নববর্ষে রমার একটা ছোট চিঠি এসেছিল। নিছক শুভ কামনা। খামের মধ্যে ঐ নীল প্যাডের পাতায় তিন চার লাইনের চিঠিতে শুভ কামনার চাইতে কি যেন একটু বেশি ছিল। আমি জবাব দিলাম পোস্টকার্ডে তোমার শুভ কামনার জন্য ধন্যবাদ।
বেনারসের পর রমার সঙ্গে ভালোভাবে আবার আলাপ হলো কায়রোতে। ওদের বাড়িতে মাত্র দুদিন ছিলাম। আমাকে ভালোভাবে খাওয়াবার জন্য বৌদি এমন মেতে উঠলেন যে কিচেন থেকে লিভিংরুম-এ এসে গল্প করার সময় পর্যন্ত ছিল না। আমি কিচেনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৌদির সঙ্গে গল্প করি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কয়েকটা ট্রাভেলার্স চেক ভাঙিয়ে সামান্য কিছু কেনাকাটার ছিল বলে প্রথমবার বেরুবার সময় বৌদিই বললেন, রমা তুই বরং ওর সঙ্গে যা। রমার সঙ্গেই বেরুলাম। প্রথমেই কাসর এল নীল স্ট্রিটে আমেরিকান একপ্রেসে গিয়ে ট্রাভেলার্স চেকগুলো ভাঙালাম। ব্যাঙ্ক থেকে বেরুবার সময়, রমা জিজ্ঞাসা করল, আপনি কায়রোয় এই প্রথম এলেন?
না, এর আগেও দুবার এসেছি।
তাহলে তো আপনিই আমার গাইড হতে পারেন।
একটু হাসলাম, না, অতটা চিনি না। বড় হোটেলে থেকে ট্যাকসিতে ঘুরলে কোনো কালেই কোনো শহর চেনা যায় না।
তা ঠিক।
তুমি পিরামিড-টিরামিড সব কিছু দেখেছ?
হ্যাঁ। দেখেছি।
কায়রো কেমন লাগছে?
ভালোই। বিশেষ করে নাইলের সাইডটা সত্যি ওয়ান্ডারফুল।
পরের দিন আমি, বৌদি আর রমা সিনেমা দেখলাম। বোধহয় কায়রো প্যালেসে। আমার দিন আসার ফ্লাইট ছিল অনেক রাত্রে। বৌদির অনুরোধে দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়া করেই খানিকক্ষণ ঘুমুতে হলো। সেই সেদিন বিকেলবেলায় রমার সঙ্গে আবার একটু ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত কায়রো-টাওয়ারে গেলাম। কায়রো-টাওয়ারে বসলে মনে হয় মহাশূন্যে ঘুরছি। ভারি ভালো লাগে। মজা লাগে। একটু রোমাঞ্চ উত্তেজনাও। সমস্ত কায়রো শহরটা, নাইল নদী, পিরামিড, আরো কত কি দেখা যায়।
বাবা-মা তো আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলাম, আর তুমি বুঝি আমার নিন্দা করো?
কার কাছে আপনার প্রশংসা বা নিন্দা করব বলুন?
হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, কেন? মনে মনে?
রমা যেন একটু লজ্জা পেল।
ট্যাকসিতে বাড়ি ফেরার পথে ও জিজ্ঞাসা করল, কবে বেনারস আসছেন?
ঠিক নেই।
কলকাতায় তো মাঝে মাঝেই যান?
তা যাই।
তবে?
তবে কি বেনারসে নামব? একটু হাসলাম, তোমার হোস্টেলে গিয়ে দেখা করতে ভীষণ অস্বস্তি লাগে।
কেন?
একটু ভাবলাম, জানি না কে কি ভাবব।
রমাও হাসল। বললো, মনে পাপ না থাকলে অস্বস্তি করার তো কথা নয়।
মুহূর্তের জন্য ভেবে বললাম, মনে মনে কে পাপী নয়? তুমি না?
রমা আর কথা বলেনি অনেকক্ষণ। বাড়ির কাছাকাছি এলে বললো, যাই হোক কলকাতায় যাতায়াতের পথে বেনারস নামবেন।
নামব?
হ্যাঁ, নামবেন।
হোস্টেলে গিয়ে দেখা করতে পারব না।
বেশ। আগের থেকে খবর দেবেন। আমি গিয়ে দেখা করব।
পরে বেনারসে রমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমি গিয়েছিলাম। যেতে হয়েছিল। ও তখন এম এ পড়ে। সুভাষদারা মস্কোয়। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে গণ্ডগোলের খবর পেয়েই সুভাষদা আমাকে টেলিগ্রাম পাঠালেন রমাকে দেখে খবর দেবার জন্য। আমি পৌঁছবার আগেই গণ্ডগোল বন্ধ হলেও তখনও পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। ক্যাম্পাসে ঢুকতে, বেরুতে পাস লাগে। রমা আমাকে। দেখে অবাক, আপনি হঠাৎ?
আগে বল তুমি কেমন আছ?
ও হাসতে হাসতে বললো, কেন? দেখে কি মনে হচ্ছে খারাপ আছি?
দেখে তত ভালোই মনে হচ্ছে কিন্তু খবরের কাগজ পড়ে ভেবেছিলাম হয় হাসপাতালে নয়তো পুলিশ লক-আপে তোমাকে দেখতে পাব।
তাহলে তো আপনার আশা ভঙ্গ করলাম।
নিঃসন্দেহে আশাভঙ্গ হলো কিন্তু সেজন্য তোমার বাবা-মা অত্যন্ত সুখী হবেন। একটু থেমে একবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে সুভাষদার টেলিগ্রামটা ওকে দিলাম।
টেলিগ্রামটা পড়েই ও চমকে উঠল, সে কি। বাবা আপনাকে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন?