এক সপ্তাহের মধ্যেই রমার চিঠি পেলাম, আপনার চিঠি পেয়ে খুব ভালো লাগল। রবিবার ছুটি। সোমবার আমাদের কোনো ক্লাস থাকে না। সুতরাং যে কোনো রবিবার সকালে আসতে পারেন। আমি কী গেস্ট হাউসে আপনার থাকার ব্যবস্থা করব? নাকি হোটলেই থাকবেন? জানাবেন। আসার আগে হোস্টেল সুপারিন্টেডেন্টকে নিশ্চয়ই একটা টেলিগ্রাম করবেন।
শেষে লিখেছে, আমি হারিয়ে যাব কেন? আপনার সঙ্গে আমাদের কি সেই সম্পর্ক?
.
আমি বেনারস গেলাম। না গিয়ে পারলাম না কিন্তু কেন গেলাম তা জানি না। আসার দিন স্টেশনে রমাকেই জিজ্ঞাসা করলাম, কেন এলাম বলো তো রমা?
ভালো লাগল না বুঝি?
ভালো লাগল বৈকি কিন্তু তবুও মনে হচ্ছে যে জন্য এসেছিলাম তা বোধহয় হলো না।
আমাকে কিছু বলবেন?
না। কি আর বলব? সঙ্গে সঙ্গেই আবার প্রশ্ন করলাম, তুমি কিছু বলবে?
ট্রেন ছেড়ে দিল। আমার প্রশ্নের জবাব দেবার অবকাশ পেল না রমা।
অদৃষ্টের এমনই যোগাযোগ ও মস্কো যাবার সময় আমি দিল্লিতেই থাকতে পারলাম না। কমনওয়েলথ প্রেস ইউনিয়নের স্কলারশিপ নিয়ে এক বছরের জন্য লন্ডন চলে গেলাম।
.
এই রমার সঙ্গেই দেবব্রতর বিয়ে হলো। কার্ড দেখে প্রথমে বুঝতে পারিনি। ওর ভালো নাম যে রঞ্জনা, তা আমি জানতাম না। তাছাড়া দেবব্রতর এক দিদি খুব ছেলেবেলায় মারা যান। তার নামও রমা ছিল বলে ওরা রঞ্জনা বলেই ডাকেন।
ঢাকুরিয়ায় সুভাষদাদের বাড়ি আছে। তাছাড়া ওঁর বাবা জীবিত বলে কলকাতাতেই বিয়ে হয়। এর কদিন পরেই আমি ফিরে এলাম। বিয়ের পর ডক্টর চৌধুরী দিল্লিতে রিসেপসন দিলেন। ঐ রিসেপসনে গিয়ে বিয়ের গল্প শুনে আমি তাজ্জব।
এম-এ পরীক্ষা দিয়ে রমা মস্কো যাচ্ছিল। অত্যন্ত জরুরী কারণে ডক্টর চৌধুরীও মস্কো যাচ্ছিলেন ঐ একই ফ্লাইটে। পালামের ডিপারচার লাউঞ্জে কেউই কাউকে খেয়াল করেননি। এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট। অনেক ভারতীয় যাত্রী। সুতরাং খেয়াল হবার কোনো অবকাশও ছিল না। দিল্লি থেকে সোজা মস্কো, তারপরই লন্ডন। ঠিক সময়ই প্লেন টেক অফ করল। কাবুল ওভার-ফ্লাই করে হিন্দুকুশ পর্বতের উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময়ই এঞ্জিনে গণ্ডগোল দেখা দিল। মস্কো নয়, তাসখন্দেই প্লেন ল্যান্ড করল। তাসখন্দ এয়ার পোর্টের ট্রানজিটে লাউঞ্জেই রমার সঙ্গে ডক্টর চৌধুরীর প্রথম আলাপ। অনেকক্ষণ চুপচাপ পাশাপাশি বসেছিলেন দুজনে। তারপর ডক্টর চৌধুরীই প্রথম আলাপ শুরু করলেন, লন্ডন যাচ্ছেন?
না, মস্কো।
কেন, স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে যাচ্ছেন?
আমি বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, মানে এম-এ পরীক্ষা দিয়ে বাবা-মার কাছে যাচ্ছি।
আপনার বাবা-মা মস্কো থাকেন?
থাকেন মানে এখন ওখানেই পোস্টেড।
দুজনেই ইংরেজিতে কথা বলছেন। কেউই জানেন না কে কোথাকার লোক। ডক্টর চৌধুরী। জানতে চাইলেন, আপনার বাবা কি আমাদের এম্বাসীতে আছেন?
হ্যাঁ।
আপনার বাবার নামটা জানতে পারি?
রমা হাসতে হাসতে বললো, নিশ্চয়ই। আমার বাবার নাম সুভাষ রায়।
এবার ডক্টর চৌধুরী খুশীতে চমকে উঠলেন, আপনি বাঙালি?
আমাকে আপনি বলার দরকার নেই। আমি আপনার চাইতে অনেক ছোট।
দেবতোষ চৌধুরী খুশী হয়ে বললেন, আজকাল আপনি বলাটাই নিরাপদ–কারণ অধিকাংশ। ছেলেমেয়েরাই তুমি বলা পছন্দ করে না।
বড়দের কাছে ছোট হতে আমার ভালোই লাগে।
আধুনিক বিমান যত দ্রুত গতিতে দেশ দেশান্তর পার হয়, বিকল হলে তত বেশি সময় নষ্ট করে। অধিকাংশ যাত্রী অধৈর্য হলেও ডক্টর চৌধুরী আর রমা মনের আনন্দে গল্প করেন।
কি আশ্চর্য! এতক্ষণ তোমার সঙ্গে গল্প করছি কিন্তু তোমার নামটাও জানলাম না।
আমার নাম রঞ্জনা রায়।
বাঃ! বেশ সুন্দর নাম! আমার নাম দেবতোষ চৌধুরী। লোকে বলে ডক্টর চৌধুরী।
মস্কো এয়ারপোর্টেই সুভাষদা আর বৌদির সঙ্গে ডক্টর চৌধুরীর আলাপ হলো। আলাপ না থাকলেও ডক্টর চৌধুরী সুভাষদার অপরিচিত ছিলেন না। ফার্স্ট সেক্রেটারি পদ্মনাভন ও সোভিয়েট একাডেমী অফ সায়েন্সের একজন প্রতিনিধি তাকে রিসিভ করতেই এয়ারপোর্টে এসেছে, তাও জানেন। আলাপ হয়ে খুব খুশী হলেন। এয়ারপোর্ট থেকে বিদায় নেবার আগে ডক্টর চৌধুরী সুভাষদাকে বললেন, মিঃ রায়, রঞ্জনা একদিন আমাকে খাওয়াবে বলছে। আপনার আপত্তি নেই তো?
সে তো সৌভাগ্যের কথা।
মাত্র একদিন নয়, চার-পাঁচ দিন উনি সুভাষদার অ্যাপার্টমেন্টে এলেন, খেলেন, গল্প করলেন। একদিন রমাকে নিয়ে ক্রেমলিন প্যালেস দেখতে গেলেন। গ্রান্ড ক্রেমলিন প্যালেস, লেনিনের। পড়াশুনার ঘর, রেড স্কোয়ার ঘুরতেই ডক্টর চৌধুরী নিজেদের পরিবারের, নিজের, দেবব্রতর অনেক কথা বলেন। একটা কথা বলব রঞ্জনা?
সেজন্য অনুমতি চাইছেন কেন?
কথাটা একটু জরুরী। তাছাড়া তোমার ভবিষ্যতের প্রশ্ন জড়িত বলেই অনুমতি চাইছিলাম।
রমা চুপ করে রইল।
তুমি অনুমতি দিলে দেবুর সঙ্গে তোমার বিয়ের প্রস্তাব করতাম তোমার বাবা-মার কাছে।
রমা নিরুত্তর থেকেছে।
রমা রঞ্জনা হয়ে গেল।
০৪. রমার বিয়ে হয়ে ভালোই হলো
রমার বিয়ে হয়ে একদিক থেকে ভালোই হলো। ওর বাবাকে আমি দাদা বলি, মাকে বৌদি। কিন্তু ওঁদের চাইতে আমি অনেক ছোট, হাজার হোক আমি জার্নালিস্ট। কাজকর্মে কখনও কখনও বিদেশ যাই। আলাপ হয় বহু ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে। ঘনিষ্ঠতাও হয় কয়েকজনের সঙ্গে। সুভাষদাদের সঙ্গেও হয়েছে। কিন্তু তাই বলে তো ওঁকে আমি কাকাবাবু বা মামাবাবু বলতে পারি না। দাদা বলি। মিসেস জয়ন্তী রায়কে বৌদি বলি। এই রকম অজস্র দাদা-বৌদি আমার আছে। পার্লামেন্টের বহু প্রবীণ সদস্যকেও দাদা বলি। সেন্ট্রাল হলে বসে রসের গল্প করি। অথচ ওঁদের অনেকেরই নাতনীদের সঙ্গে নিঃসন্দেহে আমি প্রেম করতে পারি।