বৌদি হাসতে হাসতে ড্রইংরুম থেকে ভিতরে চলে গেলেন।
সুভাষদা বললেন, ও তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া করে সিনেমায় যাবে ভেবেছিল। তুমি দেরি করে আসার জন্য…
সে কথা তো আমাকে আগে বলতে হয়।
খেতে বসে খুব গম্ভীর হয়ে বললাম, জানেন বৌদি, আজ ভীষণ সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু…
সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বৌদি বললেন, নিশ্চয়ই তোমার দাদা কিছু বলেছেন।
সুভাষদা বললেন, আমি তো কিছু বলিনি।
আমিও বললাম, দাদা কি বলবেন? সঙ্গে সঙ্গে বললাম, কালকে নিশ্চয়ই যাব।
দয়া করে একটু আগে থেকে জানিও।
.
দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার জন্য হিন্দী বাংলা সিনেমা দেখার জন্য বৌদির খুব আগ্রহ। সময় পেলেই আমরা দুজনে সিনেমায় যাই। সুভাষদা যান না। সিনেমায় ওঁর ভীষণ অরুচি। উনি বাড়িতে বসে বসে বই পড়েন অথবা কোনো পার্টিতে যান। কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা দিয়ে, সিনেমা দেখে, এখানে-ওখানে বেড়িয়ে দিনগুলো হারিয়ে যায়। ফুরিয়ে যায়। ওঁরা ছুটিতে কলকাতা যাবার পথে বেনারস থেকে রমাকে নিয়ে নেন। আমি দিল্লিতেই থাকি। কাজ করি। অফিসের কাজে বাইরে যাই। যাই কলকাতাতেও। দুটো একটা দিন খুব হৈ-চৈ করে আবার ফিরে আসি রাধাকিষণের কাছে।
রমা বি. এ. পাস করে। এম. এ. পড়তে শুরু করে। দিল্লি আসে।
বাবুজি! বাবুজি! চা
দর মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়েই উত্তর দিই, কি হলো?
দিদি আয়া হ্যায়।
কোনো দিদি এলো রে?
রমা দিদি।
মুখ থেকে চাদর সরিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করি, কে এসেছে?
রমা দিদি।
সঙ্গে সঙ্গে রমা ঘরে ঢুকল। কটা বাজে জানেন!
কটা?
পৌনে দশটা!
পৌনে দশটা?
বিশ্বাস না হয় নিজের ঘড়িটা দেখুন!
রাধাকিষণ চলে গেল। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘড়ি খুঁজছি। রমা বললো, আপনার হাতেই তো ঘড়ি আছে।
ঘড়িটা দেখেই লজ্জিত হয়ে ওর দিকে তাকালাম।
কোনো স্বপ্ন দেখছিলেন নাকি? হাসতে হাসতে রমা প্রশ্ন করল।
কেন বলল তো?
হাতে ঘড়ি রয়েছে আর খুঁজে বেড়াচ্ছেন…
স্বপ্ন দেখার বয়স কি আর আছে?
আর লেকচার দিতে হবে না। এবার উঠুন।
কিন্তু তুমি কবে এলে, তাই আগে বল।
কাল রাত্রে এসেছি।
কই তোমার মা বাবা তো কিছু জানাননি আমাকে।
ওঁরাও ঠিক জানতেন না। রিজার্ভেশন পাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা চারটি মেয়ে একসঙ্গে চলে এলাম।
ভালোই করেছ। বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললাম, একটু বসো। এক্ষুনি আসছি।
বাথরুম থেকে বেরুতেই রাধাকিষণ চা দিল। রমাকে শুধু চা দেবার জন্য খারাপ লাগল। ওকে শুধু চা দিলে কেন?
রমা বললো, আমি খেয়ে এসেছি।
তাহলেও সামান্য কিছু তো…
এখন কিছু খাব না।
ঠিক তো?
তবে কি আমি মিথ্যে বলছি?
রাধাকিষণ চলে যেতেই রমা জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আমি একটু মোটা হয়েছি, তাই না?
একবার ভালো করে ওকে দেখলাম।মোটা হয়েছ কিনা জানি না, তবে তোমাকে দেখতে আরো ভালো লাগছে।
ঐসব আজেবাজে কথা বললে এক্ষুনি চলে যাব।
আজেবাজে কথা বলছি নাকি?
তবে কি?
সত্যি বলছি, ইউ লুক ভেরী প্রেটি!
থাক। আর আমার রূপের তারিফ করতে হবে না।
খালি চায়ের কাপ সরিয়ে রেখে জিজ্ঞাসা করলাম, বল কেমন আছো?
ভালোই আছি।
পড়াশুনা কেমন চলছে?
মোটামুটি।
মোটামুটি কেন?
খুব বেশি পড়াশুনা করতে আর ভালো লাগে না।
তাহলে কি এবার বিয়ে করতে চাও?
হ্যাঁ। বিয়ে করার জন্য তো আমি পাগল হয়ে উঠেছি।
খুব অস্বাভাবিক নয়।
থাক! ওসব কথা আপনাকে ভাবতে হবে না।
সেই ভালো। এইভাবে যতদিন থাকো, ততই ভালো।
মাত্র দেড় মাসের ছুটি। তাহোক খুব আনন্দে কাটল দিনগুলো। রমা এলে ওদের বাড়িতে আমার যাতায়াত বেড়ে যায়। বৌদি প্রায়ই কিছু স্পেশাল রান্না করেন আর আমিও তার অংশীদার হই। দুচারদিন পর পর রমাও আমার আস্তানায় আসে।
জান রমা, তুমি এলে দিনগুলো বেশ কেটে যায়।
তাই তো দিল্লি থেকে গেলেই ভুলে যান।
চিঠি লিখি না মানেই কি ভুলে যাই?
কলকাতায় যাতায়াতের পথেও তো একবার নামতে পারেন।
সব সময় ঠিক সম্ভব হয় না।
এই এক বছরের মধ্যে একবারও সম্ভব হলো না?
এবার ঠিক যাবো।
কথা দিচ্ছেন?
হঠাৎ ওর হাতটা চেপে ধরে বললাম, তোমাকে ছুঁয়ে বলছি।
আমি তাড়াতাডি হাতটা সরিয়ে নিতেই ও হাসতে হাসতে বললো, আসবেন। খুব খুশী হব।
.
সুভাষদার দিল্লি বাসের মেয়াদ তিন বছর। কোথা দিয়ে কেমন করে যে তিনটি বছর পালিয়ে গেল, তা বুঝতেই পারলাম না। দুঃখ দুর্দিনের রাত্রি শেষ হতে চায় না, অন্ধকার চিরস্থায়ী মনে হয় কিন্তু আনন্দের দিনগুলো, বাসর রাত্রি যেন নিমেষেই ফুরিয়ে যায়। সুভাষদা মস্কো বদলী হলেন। রমা বেনারস থেকে আসতে পারেনি। কয়েক মাস পরেই এমএ পরীক্ষা। পরীক্ষা দিয়েই মস্কো যাবে। যাবার দিন শুধু বৌদি নয়, সুভাষদাও রমার জন্য একটা ছেলে দেখতে বললেন।
নিশ্চয়ই চেষ্টা করব।
বৌদি বললেন, বিয়ে দিতে পারছিলাম না বলেই এম-এ পড়ালাম কিন্তু এবার তো বিয়ে না দিলেই নয়। তাছাড়া ওর রিটায়ার করার টাইমও এসে গেল।
আমি চুপ করে সব কিছু শুনলাম কিন্তু মনে মনে জানতাম, রমার বিয়ের পাত্র আমি কখনই খুঁজে বের করব না।
সুভাষদা মস্কো রওনা হয়ে যাবার পরই রমাকে একটা চিঠি লিখলাম, তোমার বাবা-মাকে মস্কোর প্লেনে চড়িয়ে দেবার পরই খেয়াল হলো তোমার বেনারস বাসের মেয়াদও দীর্ঘ নয়। কয়েক মাস পরেই তোমার ফাইনাল পরীক্ষা। তারপর তুমি মস্কো যাবে। তারপর? অনেক কিছু ঘটতে পারে তারপরে। হয়ত তুমি হারিয়েই যাবে। আর তোমার সঙ্গে আমার দেখাই হবে না। হওয়া সম্ভব হবে না। ভবিষ্যতে আরো কত কি হতে পারে, তাই না? যাই হোক দু একদিনের জন্য বেনারস যাব ভাবছি। তোমার পড়াশুনার বিশেষ ক্ষতি না হলেই যাব। নয়তো তোমার মস্কো যাবার সময় নিশ্চয়ই দেখা হবে।