না।
জল পিপাসা লাগেনি?
আপনার বাড়ি গিয়ে চা খাব।
যাবে?
যাব না কেন?
পাঁচ মিনিটে আমার কাকানগরের আস্তানায় এসে হাজির হলাম। রাধাকিষণ দরজা খুলতেই বললাম, সকালবেলায় যে বাবুজি এসে আমাকে নিয়ে গেলেন, তার মেয়ে। রমা।
রাধাকিষণ হাত জোড় করে নমস্কার করল, নমস্তে দিদি!
নমস্তে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রমা বললো, তোমার কাছে চা খেতে এলাম।
জরুর। আপনারা বাবুজিকে এত ভালোবাসেন আর আমি আপনাকে চা খাওয়াব না?
রমা তখনও দাঁড়িয়ে। হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, আমরা তোমার বাবুজিকে ভালোবাসি সেকথা তোমাকে কে বললো?
বিলাইত-আমেরিকা গেলে আপনারা বাবুজিকে কত যত্ন করেন, সে-সব আমি জানি।
রমা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি বুঝি ওকে সবকিছু বলেন?
আর কাকে বলব বল?
রাধাকিষণ ভিতরে গেল। আমি বললাম, বসো।
আপনার বাড়িটা দেখব না?
সেজন্যে তো অনুমতি নেবার প্রয়োজন নেই।
আমি ড্রইংরুমে বসলাম। রমা আমার আস্তানা দেখার জন্য ভিতরে চলে গেল। খানিকক্ষণ পরে ফিরে এসে বললো, আপনার টেবিলের উপর আমার একটা জিনিস ছিল। আমি নিয়ে নিলাম।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার টেবিলে তোমার জিনিস?
হ্যাঁ।
কি ছিল?
আপনি জানেন না?
কই না তো।
আমার একটা চিঠি ছিল। আমি নিয়ে নিলাম।
হেসে উঠলাম।তোমার বাবা মার চিঠি পেলেই তোমাকে একটা চিঠি লিখতাম কিন্তু অধিকাংশ চিঠিই শেষ করতে পারতাম না বলে পোস্ট করা হতো না।
রমা বসতে বসতে বললো, সে তো চিঠি দেখেই বুঝতে পারছি। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল, শেষ করতে পারতেন না কেন?
কি লিখব কিছুতেই ভেবে পেতাম না।
চমৎকার লোক আপনি।
চমৎকার না হলেও একটু অদ্ভুত নিশ্চয়ই।
রাধাকিষণ চা আর এক প্লেট স্যান্ডউইচ সেন্টার টেবিলে রেখে জিজ্ঞাসা করল, আর কিছু আনব?
রমা বললো, না, না, আমি শুধু চা খাব।
আমি বললাম, প্রথম দিন আমার বাড়িতে এসে শুধু চা খেয়ে যেও না।
আপনি তো আমাকে আসতে বলেননি; আমি নিজেই তো এলাম।
ঠিক, সামাজিক কাণ্ডজ্ঞান যে আমার বিশেষ নেই, তা বোধহয় এতদিনে তোমরা বুঝেছ?
শুধু সামাজিক কেন, অনেক কাণ্ডজ্ঞানই আপনার নেই।
ছেলেদের চাইতে মেয়েদের কাণ্ডজ্ঞান অনেক বিষয়েই বেশি হয়। রমা আমার চাইতে বেশ কয়েক বছরের ছোট হলেও হয়তো আমার চাইতে ওর কাণ্ডজ্ঞান বেশি। আমি চুপ করে গেলাম।
কি হলো? কথা বলছেন না যে? রমা আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।
কই কিছু না তো।
আপনি নিশ্চয়ই আমার কথায় রাগ করেছেন।
না, না, রাগ করবো কেন?
তবুও রমা একটু কৈফিয়ত না দিয়ে পারল না, আপনার সঙ্গে আমরা বড় বেশি জড়িয়ে পড়েছি। তাই কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই অনেক সময় অনেক কথা বলি কিন্তু মনে কোনো…
মাঝ পথেই আমি ওকে বাধা দিলাম, তা আমি জানি। খুব ভালো করেই জানি।
আমার উপর রাগ করেননি তো?
না।
ঠিক বলছেন?
তোমার উপর বোধহয় আমি কোনদিনই রাগ করব না।
.
গরমের ছুটিটা দেখতে দেখতে ফুরিয়ে গেল। তারপর একদিন রমা বেনারস ফিরে গেল। সুভাষদার কাছে পৌঁছানোর সংবাদ এলো টেলিগ্রামে, রিচড় সেফলি। কদিন পরে আমার কাছেও একটা চিঠি এলো, ছুটির পর হোস্টেলে ফিরে এসে প্রত্যেকবারই খারাপ লাগে। এবার আরো বেশি। খারাপ লাগছে। বিদেশের চাইতে দিল্লিতে বাবা-মাকে আরো আরো অনেক বেশি কাছে পেয়েছি। তাছাড়া আপনার জন্য মে-জুন মাসের দিল্লির রুক্ষতা কখনও অনুভবই করলাম না। কলকাতা যাতায়াতের পথে নিশ্চয়ই বেনারস ঘুরে যাবেন।
শেষে ছোট একটা টিপ্পনী–অসমাপ্ত চিঠিই ডাক বাক্সে ফেলবেন।
ঐ ছোট্ট টিপ্পনীর জন্যই একটা চিঠি লিখে ফেললাম। চিঠি লেখার অভ্যাস আমার নেই, তা তুমি জান। তবুও যা দুটো-একটা চিঠি লিখব, তা কখনই অসমাপ্ত হবে না। টাইপ রাইটার খট খট করে রিপোর্ট লিখতে লিখতে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে কলম ধরতে পারি না। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন এজন্য অনেকেই আমার উপর অসন্তুষ্ট কিন্তু তোমাদের মতো যাদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা মানসিক, তারা কখনই আমাকে ভুল বুঝবে না। কলকাতায় যাতায়াতের পথে সব সময় বেনারস যাওয়া সম্ভব না হলেও মাঝে মাঝে নিশ্চয়ই দেখা হবে।
.
সুভাষদা আর জয়ন্তী-বৌদির জন্য আমার জীবনধারাটাও বদলে গেল। শনিবার একটু রাত করে গেছি। দরজা খুলেই বৌদি বললেন, নিশ্চয়ই কোনো ডিপ্লোম্যাটিক পার্টিতে হুইস্কি খেতে গিয়েছিলে?
বৌদির কথায় আমি হাসি। বলি, ডিপ্লোম্যাটিক পার্টিতে হুইস্কির জন্য যাই না, যাই কিছু নিউজ পাবার লোভে।
ওই ছুতোর নাম করে জার্নালিস্টগুলো শুধু মদ খেতেই যায়।
বৌদির মুখের সামনে আলতো করে একটা হাত দিয়ে বললাম, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর বকাবকি করবেন না। আশপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন শুনলে কি ভাববে বলুন তো?
বৌদি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, তোমার একটু বদনাম হওয়াই দরকার।
ঘরে ঢুকতেই সুভাষদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই যদি বৌদির রূপ হয় তাহলে কি হতো ভাবতে পার?
বৌদি গম্ভীর হয়ে বললেন, আমরা না থাকলে তোমাদের যে কি দশা হতো তা একবার দেখতে ইচ্ছে করে।
আমি সুভাষদার পাশে বসে বললাম, আমাকে দেখেও তা বুঝতে পারছেন না?
তুমি তো হাফ ব্যাচেলার!
তার মানে?
তোমার সঙ্গে কত বৌ-বৌদির কত রকমের ঘনিষ্ঠতা যে…
আমি মাথা নাড়তে নাড়তে বললাম, শুধু একবার প্রেম করে ব্যর্থ হওয়া ছাড়া আমার জীবনে আর কোনো মেয়ের আবির্ভাব হয়নি।