আমি ওর প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কি করে জানলে আমিই…
আপনার কতগুলো ছবি আমার কাছে তা জানেন?
আমার ছবি?
হ্যাঁ, আপনার ছবি। মা পাঠিয়েছেন।
তাই নাকি?
তা না হলে আমি কি করে আপনাকে দেখেই উপরের বারান্দা থেকে নেমে এলাম?
সেদিন বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে কিছু সময় কাটিয়েই হোটেলে ফিরে এলাম। ফিরে আসার আগে রমা জিজ্ঞাসা করল, কদিন এখানে থাকবেন?
কদিন মানে? কালই রাত্রে চলে যাব।
সেকি? দুচার দিন থাকবেন না?
দুচার দিন কেন থাকব?
আপনি থাকলে আমিও একটু ঘুরে ফিরে বেড়াতে পারব, নয়তো ওই হোস্টেলের মধ্যেই…
কেন? তোমরা বেড়াতে যাও না?
বেরুতে দেয় নাকি? বাবা চিঠি দিয়েছিলেন বলেই তো আপনার সঙ্গে একটু বেরুতে পারব।
পরের দিন রাত্রেই আমি কলকাতা রওনা হলেও সারাদিন দুজনে খুব ঘুরেছিলাম। টাঙ্গায় চড়ে সারনাথ যাবার পথে আমি আর না বলে পারলাম না, তুমি বাবার বুদ্ধি আর মার সৌন্দর্য পেয়েছ, তাই না?
রমা হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ একথা বলছেন?
ভাবছিলাম বলব না কিন্তু শেষ পর্যন্ত না বলে থাকতে পারলাম না।
.
এবার রাষ্ট্রপতি আমাকে দেখিয়ে বললেন, একে একদিন রাইস অ্যান্ড ফিসকারী খাইয়ে দিও। মাছের ঝোল-ভাত না খেলে তো কোনো বাঙালিরই শান্তি নেই।
তিনদিন ওয়াশিংটনে কাটিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে। ওয়াশিংটন থেকে রওনা হবার আগে বৌদি আমাকে বললেন, নিউইয়র্ক থেকেই পালিয়ে যাবেন না, ওঁর সঙ্গে ফিরে আসবেন। সুভাষদাকেও সতর্ক করে দিলেন, না পারলে বলল আমি স্যারকে বলছি।
সুভাষদা হাসতে হাসতে বললেন, তুমি প্রেসিডেন্টের ছাত্রী বলে সামান্য একজন ফাস্ট সেক্রেটারিকে ভয় দেখাচ্ছ কেন?
ওয়াশিংটন ছাড়ার সময় বৌদির আতিথ্য উপভোগ করে ফিরে আসার সঠিক কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও ফিরে এসেছিলাম। ওয়াশিংটন থেকে অ্যাম্বাসেডর, মিনিস্টার কাউন্সেলার আর ফাস্ট সেক্রেটারি সুভাষদা-ও প্রেসিডেন্টস পার্টিতে যোগ দিলেন। ঘুরলাম চিকাগো, বস্টন স্যানফ্রান্সিসকো, নিউইয়র্ক।এ সাত দিন সুভাষদার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশলাম। রোজ রাত্রে আমরা দুজনে অনেক গল্প করতাম। সুভাষদা ডিপ্লোম্যাট। কুটনীতিবিদ। উঁচু গলায় কোনো কিছুপ্রচার করা তার ধর্ম নয়। স্বভাবও নয়। উন্মত্ত পদ্মা পাড়ের মানুষ হয়েও ওঁর স্বভাবটি ভাগীরথীর মতো শান্ত ও মিষ্টি। উচ্ছ্বাস নেই কিন্তু মাধুর্য আছে। সুভাষদার সঙ্গে নিউইয়র্ক থেকে আবার ওয়াশিংটন ফিরে গেলাম। সাতদিন ওদের অ্যাডান্স মিল রোডের অ্যাপার্টমেন্টে ছিলাম। অবিস্মরণীয় সাতটি দিন। রমা তখন ছিল না। বৌদির পদাঙ্ক অনুসরণ করে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। কথা দিয়েছিলাম দেশে ফিরে এসে রমার সঙ্গে দেখা করব।
.
এর কবছর পর ভারতীয় সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে কায়রো গিয়ে দেখি সুভাষদা আমাদের অ্যাম্বাসীর মিনিস্টার কাউন্সেলার। তখন রমাও ওখানে। বেশিদিন নয়, মাত্র দুটি দিন ওদের কাছে ছিলাম। আসার দিন এয়ারপোর্টে পৌঁছে বৌদিকে বললাম, বৌদি, ঋণের বোঝা বড্ড বেশি বাড়ছে।
কার? তোমার না আমার?
আমি না হেসে পারলাম না। বললাম, আপনার।
বৌদি জবাব দিলেন, ন্যাকামি না করে মেয়েটার একটা পাত্র দেখে দাও তো।
বৌদির অনুরোধটা শুনতে আমার ভালো লাগেনি। কেন, তা জানি না। তবে বড় বেসুরো মনে হয়েছিল। একটু আহত, একটু বেদনাবোধ করেছিলাম মনে মনে। রমাকে আমি ভালোবাসিনি কিন্তু তবুও ও বিয়ে হয়ে বহু দূরে চলে যাক, তাও চাইনি। চাইতে পারিনি। বললাম, বিয়ের জন্য এত ব্যস্ত কি?
ব্যস্ত না হলেও চুপ করে বসে থাকার মতো বয়সও আর ওর নেই।
না, না, এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবেন না। আগে এম. এ. পাস করুক, তারপর ভেবে দেখা যাবে। এবার রমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি রমা, এম. এ. পড়বে তো?
ও সোজাসুজি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটু বাঁকা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ছেলেদের মতো মেয়েরা বিয়ে পাগল হয় না।
ওসব কথা আমাকে বলল না। আমি বরযাত্রী পর্যন্ত যাই না। একটু থেমে ওদের দুজনকে দেখে নিয়ে বললাম, বরযাত্রী না গেলেও তোমার বিয়েতে নিশ্চয়ই মাতব্বরি করব।
কেউ আপনাকে মাতব্বরি করতে বলছে না।
.
সুভাষদার কায়রো বাসের পালা শেষ হলো, দিল্লি ফিরে এলেন। রমার পাত্রের হদিশ এখনও দিতে পারিনি কিন্তু তবুও যে বৌদি দিল্লি এসেই আমার কথা মনে করেছেন, সুভাষদার মতো কুঁড়ে ঘরকুনো লোককে যে ছুটির দিন সকালে বের করতে পেরেছেন, তার জন্য কৃতজ্ঞ না হয়ে পারলাম। না। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে সুভাষদার সঙ্গেই বেরিয়ে পড়লাম। বৌদি সাদরে অভ্যর্থনা করলেন, একটু ঝগড়া একটু বকাবকি করলেন। ঠিক সেই আগের মতোই; একটুও পরিবর্তন হয়নি কিন্তু রমা যেন কেমন পাল্টে গেছে। সোজাসুজি আমার দিকে তাকাতে পারল না, দৃষ্টিতে সলজ্জ আবরণ। কথাবার্তা আলাপ-আচরণে একটু সংযত ভাব। সামান্য জড়তা, দ্বিধা। বুঝলাম শরৎ হেমন্ত শেষে। বসন্ত সমাগত। অস্বাভাবিক নয়। থার্ড ইয়ারের ছাত্রী।
খাওয়া-দাওয়ার আগে আমি আর সুভাষদা ড্রইংরুমে বসে গল্প করছিলাম। রাজনৈতিক, কুটনৈতিক বিষয়ের গল্প। আচ্ছা সুভাষদা, ইন্ডিয়া সম্পর্কে ইজিপ্টের অ্যাটিচিউড কি একটু বদলেছে?