এদের সবাইকে টেক্কা দেওয়া ছাড়াও সারা শহরের মানুষকে চমকে দেবার জন্য অবলাকান্ত পুরনো কুঠীবাড়িটাকে একটা প্রাসাদে রূপান্তরিত করতে কলকাতা থেকে সিমেন্ট-লোহালক্কড় ছাড়াও ইটালি থেকে মার্বেল ও জয়পুর থেকে মিস্ত্রী-কারিগর আনলেন। গৃহপ্রবেশের আগে অবলাকান্ত নিজে শহরের প্রত্যেকটি বাঙালীর বাড়িতে গিয়ে করজোড়ে নিবেদন করলেন, আমি একজন দীনদরিদ্র ব্রাহ্মণ। প্রয়াগ থেকে নতুন এসেছি এবং আপনাদের এই শহরে স্থায়িভাবে বসবাসের অভিপ্রায়ে কোন মতে দিন কাটাবার মত একটা কুটির বানিয়েছি। গৃহপ্রবেশের দিন আপনারা দয়া করে সপরিবারে সবান্ধবে পায়ের ধুলো দিলে কৃতার্থ বোধ করব।
সারা শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যেই রটে গিয়েছিল, এলাহাবাদের রাজার কোঠী তৈরী হচ্ছে। বাঙালীটোলার বাঙালীরা অবশ্য জানতেন না, এলাহাবাদের রাজার বাড়ি না, অবলাকান্ত বাঁড়ুজ্যে বলে কোন এক জমিদার এ বাড়ি তৈরি করছেন। জমিদার না হলে কেউ ইটালি থেকে মার্বেল পাথর আনাতে পারে?
যাইহোক গৃহপ্রবেশের নিমন্ত্রণ পর্ব শেষ হতে না হতেই বাঙালীটোলার ঘরে ঘরে অবলাকান্তকে নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হল। কেউ কেউ বললেন, জমিদার হলেও লোকটি বেশ বিনয়ী। আবার কেউ কেউ বললেন, নতুন এসেছেন তো! তাই সমাজে ঢোকার চেষ্টা করছেন। আবার দু-চারজন বলাবলি করলেন যে এই উপলক্ষে সবাইকে দেখিয়ে দেবেন, কত বড় জমিদার। তবে সবাই ঠিক করলেন, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতেই হবে। হাজার হোক জমিদার। তারপর বাড়ি এসে যখন নেমন্তন্ন করেছেন তখন না যাওয়া অত্যন্ত অন্যায় ও অসামাজিক কাজ হবে।
শহরের ধারের গঙ্গার মত এখানকার বাঙালী সমাজেও জোয়ার ভাটা হত না। গতানুগতিকভাবেই তাদের দিন কাটছিল। যতীন মুখুজ্যে ও নগেন গাঙ্গুলীর মত কয়েকজন মাত্র উপলব্ধি করলেন, অবলাকান্ত ওদের শান্তিতে থাকতে দেবেন না।
গৃহপ্রবেশের দিন দুপুরের মধ্যে বাঙালীটোলার ঘরে ঘরে রটে গেল, গৃহ প্রবেশের পূজা করার জন্য অবলাকান্ত পুরুতঠাকুরকে একশ টাকা দক্ষিণা, রুপোর বাসন-কোসন ও বহু কাপড়-চোপড় ছাড়াও দশ বিঘে জমি দান করেছেন। কোর্ট থেকে ফিরে এসে গিন্নীর কাছে এই সংবাদ শুনেই যতীন মুখুজ্যে বললেন, বুঝলে গিন্নী, এ হারামজাদা আমার মত দু-একজনকে অপমান করার জন্যই এইসব বদমায়েসী শুরু করেছে।
গিন্নী পান চিবুতে চিবুতে বললেন, সরলা পিসীর কাছে খবরটা শুনে আমি তো ভাবলাম, জমিদার হলেও লোকটা বড় ধাম্মিক।
ঘোড়ার ডিম ধার্মিক! শালা টাকার গরম দেখাচ্ছে।
গিন্নী রাঁধুনী-মার হাত থেকে লুচি-হালুয়ার পাত্র নিয়ে স্বামীর সামনে রেখেই বললেন, তাহলে আমরা আর ওর রাজবাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছি না।
না, না, গিন্নী যেতে আমাদের হবেই।
যে তোমাকে অপমান করতে চায়, তার বাড়িতে যাব কেন?
যতীন উকিল একটু হেসে গিন্নীর দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমি তো চাণক্য শ্লোক পড়নি। পড়লে জানতে যুদ্ধ জয় করতে হলে আগে শত্রু সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ভিতরের সব খবর জেনে নিতে হয়। আমরা শুধু আজই যাব না, নিয়মিত যাতয়াত করব।
অবলাকান্ত সত্যি এলাহি ব্যাপার করেছিলেন। গেটের কাছেই সব অতিথি-অভ্যাগতদের মাথায় আতর জল ছিটিয়ে দেওয়া হল। কর জোড়ে অভ্যর্থনা করলেন স্বয়ং অবলাকান্ত। পারস্য দেশীয় কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে অতিথিরা প্যালেসের সামনে পৌঁছতেই তাদের প্রত্যেকের গলায় মালা, হাতে গোলাপফুল দেওয়া হল। ওদিকে কাশীর ওস্তাদ নাসিরুদ্দীন খাঁ সাহেব বিভোর হয়ে সানাই বাজা চ্ছিলেন। ইটালিয়ান মার্বেল দিয়ে মোড়া সিঁড়ি পার হয়ে দোতলার মেন ড্রইং রুমে পুরুষ অতিথিরা না ঢুকতে ঢুকতেই সবার হাতে এক গ্লাস করে চন্দনের শরবত তুলে দেওয়া হল। বাঙালীটোলার বাসিন্দারা ঘরদোর সাজসজ্জা দেখে সত্যি বিস্মিত না হয়ে পারেন না। সবাই ফিসফিস করে বলাবলি করেন, লোকটার যেমন পয়সা তেমন রুচি আছে। ইতিমধ্যে হঠাৎ স্বয়ং কালেক্টর সাহেব মেমসাহেবকে নিয়ে হাজির হতেই বাঙালীটোলার সবাই যেন ভূত দেখার মত চমকে ওঠেন। এমন কি যতীন উকিল ও নগেন ডাক্তারও স্বপ্নে ভাবেননি কালেক্টর সাহেব মেমসাহেবকে নিয়ে এই সদ্য আগত অবলাকান্তর বাড়িতে গৃহপ্রবেশের নেমন্তন্ন খেতে আসবেন। তাছাড়া এ শহরে কোন বাঙালীর বাড়িতে ইতিপূর্বে কোন কালেক্টর সাহেবের শুভাগমন হয়নি। আমন্ত্রিত সম্ভ্রান্ত ধনী বাঙালীরাও বিস্মিত হলেন।
সেদিনের আমন্ত্রিত বাঙালী সজ্জনদের বিস্ময়ের পর্ব এখানেও শেষ হল না। কালেক্টর সাহেবের বিদায় লগ্নের পূর্ব মুহূর্তে অবলাকান্ত জন-কল্যাণে ব্যয় করার জন্য মেমসাহেবের হাতে পাঁচ হাজার এক টাকা দান করলেন। সমস্ত বাঙালীর সামনে কালেক্টর সাহেব বললেন অবলাকান্তর মত দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ প্রজার জন্য আমরা সত্যি গর্বিত।
বাড়িতে ফেরার পর যতীন উকিলের স্ত্রী বললেন, গল্পের বইতেই রাজবাড়ির কথা পড়েছি কিন্তু আজ সত্যি একটা রাজবাড়ি দেখলাম। লোকটার যে কত কোটি টাকা আছে, তা কে জানে।
উকিলবাবু গম্ভীর হয়ে কথাগুলো শুনে শুধু বললেন, হুঁ।
তবে লোকটার দিল আছে। তা না হলে শুধু গৃহপ্রবেশের জন্য এত টাকা ব্যয় করতে পারে।
এবার উকিলবাবুর মুখ দিয়ে আর একটি শব্দও বেরোয় না কিন্তু ওর গিন্নী চুপ করে থাকতে পারেন না। বলেন, অমিাদের এই বাঙালীটোলা কালীমন্দিরের জন্য দু-আড়াই হাজার টাকা তুলতেই সবাই হিমসিম খেয়ে গেল। তুমি পঁচিশ টাকা না দিলে তো মন্দিরটাও শেষ হত না আর এই অবলা বাঁড়ুজ্যে দুম করে পাঁচ হাজার টাকা মেমসাহেবের হাতে তুলে দিল!