না, এখানেও কামিনীরঞ্জনের জীবন-নাট্যে যবনিকা পড়ল না। বছরখানেক পর হঠাৎ একদিন কমিশনার সাহেব গোপনে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে জনস্টোন সাহেবের সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে উধাও হয়ে গেলেন। পরে অবশ্য জানা গেল, ওরা দুজনে মিশরে গেছেন।
কমিশনার সাহেবের উধাও হবার খবরে কামিনীরঞ্জন প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও মেমসাহেব বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। মেমসাহেব ওকে বললেন, খামিনী, অযোধ্যার নবাব বিন্ধ্যাচল পাহাড়ের যে ছোট্ট প্যালেসটা আমাকে দিয়েছেন, আমি সেখানেই থাকব। তুমি আমার সব বিধিব্যবস্থা করে দাও।
শুধু মেমসাহেবের না কামিনীরঞ্জনেরও জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু হল। মেমসাহেব বছরের অনেক সময়ই বিন্ধ্যাচলের প্যালেসে কাটালেও রাজা-মহারাজা-নবাবদের প্রদত্ত অন্যান্য কোঠীতেও মাঝে মাঝে কিছুদিন কাটান। কামিনীরঞ্জন জমিদারী দেখাশুনার অজুহাতে মাঝে মাঝেই মেমসাহেবের কাছে কিছুদিন কাটান।
সত্যি বলছি খামিনী, ইংরেজরা ভালবাসতে জানে না। তুমি আমার হাজব্যাণ্ড না কিন্তু তোমার কাছে আমি যে ভালবাসা, যে আদর পাই তা কোন ইংরেজ স্বামী দিতে পারবে না।
সত্যি মেমসাহেব?
হ্যা খামিনী। মেমসাহেব কামিনীরঞ্জনের গলা জড়িয়ে ধরে বলেন, খাজুরাহো টেম্পল দেখেই আমি বুঝেছি, ইণ্ডিয়ান নেটিভরা সত্যি ভালবাসতে জানে।
দুরন্ত প্রাণচঞ্চল পাহাড়ী নদীর মত কামিনীরঞ্জনের জীবনধারাও বার বার তার গতিপথ বদলেছে। বছর দুই পর এক বান্ধবীর সঙ্গে ডালহৌসী পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে এক দুর্ঘটনায় মেমসাহেব মারা গেলেন।
মেমসাহেবের অকস্মাৎ মৃত্যু কামিনীরঞ্জনের ব্যক্তিগত জীবনে যত দুঃখ বা বেদনার কারণই হোক, লাভও কম হল না। মেমসাহেবের কয়েক লক্ষ টাকার গহনা ও হীরা-জহরত ছাড়াও নানা জায়গায় চার পাঁচটি প্যালেস ও কোঠী ওরই দখলে এল।
বিহারের গঙ্গাতীরের অর্ধখ্যাত শহরের রাজাবাবুদের পরিবারের এই হল আদি ইতিহাস। তবে এইসব কাহিনী মহেন্দ্রবাবুরা কাউকে বলেন না। বলতে পারেন না। উনি যে সাতটি প্যালেসের জন্য গর্ব করেন, তার অধিকাংশই যে বার্জম্যান সাহেবের ছিল এবং তার মেমসাহেবের সঙ্গে ওর পূর্বপুরুষের অবৈধ সম্পর্কের জন্যই ওদের দখলে অসে, সে কথা কী কাউকে বলা যায়। বলা যায় না আরও অনেক কিছু।
অধিকাংশ অভিজাত পরিবারের মানুষজনই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধবকে অতীত ঐতিহ্যের দীর্ঘ কাহিনী না বলে থাকতে পারেন না কিন্তু যা বলেন না, বলতে পারেন না, সে ইতিহাস কাহিনী বোধ হয় আরও দীর্ঘ, আরও রহস্যপূর্ণ।
৪. ইংরেজ প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সঙ্গে
ইংরেজ প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র উত্তর ভারতে যে অসংখ্য বাঙালী ছড়িয়ে পড়েন, তাঁরা সবাই কামিনীরঞ্জন ছিলেন না। পেশোয়ার-রাওলপিণ্ডি থেকে গিরিডি-জসিডি-মধুপুর বা রাঁচী জামসেদপুরের স্কুল-কলেজ-লাইব্রেরী, মঠ-মন্দির, সংবাদপত্র-সাহিত্য সভা ইত্যাদির ইতিহাস একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই অসংখ্য উদার শিক্ষিত পরোপকারী বাঙালীর আশ্চর্য কীর্তি-কাহিনী জানা যাবে। বাঙালী শুধু কালীমন্দির দুর্গাবাড়ি বা থিয়েটারের ক্লাব গড়েনি বলেই আজো তারা বহু শহরে-নগরে শ্রদ্ধার আসনে আছেন।
গঙ্গাধর-কামিনীরঞ্জন বা তাদের বংশধরদের রক্তে রাজভক্তির মহা শক্তিশালী বীজ প্রায় কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মত স্থায়ী আসন বিছিয়ে বসায় শিক্ষা-দীক্ষা বা পরোপকারের বিষ ঢুকতে পারেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম রাজা অবলাকান্ত। উনি বোধ হয় ভুল করেই গর্ভধারিণীর স্মৃতিতে একটা স্কুল তৈরি করেছিলেন। অবশ্য তার কারণ ছিল।
কামিনীরঞ্জন হু এভার ম্যারেজ মাই মাদার, ইজ মাই ফাদার নীতি নিয়ে রাজার জাত ইংরেজদের ভজনায় এমনই নিমগ্ন ছিলেন যে ছেলেমেয়েদের ভদ্র-শিক্ষিত করার চেষ্টায় সারা জীবনে এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করতে পারেনি। তাই তো তাঁর মৃত্যুর পর ছেলেমেয়েদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি শুরু হতে একটুও দেরি হল না। মামলা মোকদ্দমাও চলল বেশ কয়েক বছর। তারপর শুরু হল ভাগভাগি কাড়াকাড়ি। যাই হোক শেষ পর্যন্ত কামিনীরঞ্জনের ঐশ্বর্যের এক ভগ্নাংশ নিয়ে অবলাকান্ত একদিন বিহারের এই শহরে এসে হাজির। সম্বল বলতে শদেড়েক একর চাষের জমি, একটা পুরনো কুঠীবাড়ি, কয়েক লাখ টাকার বাসন-কোসন, গহনাগাটি ও প্রায় লাখখানেক টাকার কোম্পানির কাগজ। এই সামান্য সম্বল নিয়ে গঙ্গাতীরের এই ছোট্ট শহরে মোটামুটি শান্তিতে জীবন কাটাবার আশায় উনি এখানে এলেন। ছোট হলেও শহরটি মন্দ নয়। কলকারখানা তো দূরের কথা, কোন বড় সরকারী অফিসও এখানে নেই। তবে কোর্ট-কাছারি ও কালেক্টর আছেন। কয়েক বছর আগে একটা সরকারী হাসপাতালও হয়েছে। আশেপাশের জমিতে চাষ-আবাদ ভালই হয়। এছাড়া সর্বোপরি বহু ব্রাহ্মণের বাস। ঠিক জমিদার কেউ না থাকলেও কয়েক ঘর ধনী বারেন্দ্র আছেন। তার মধ্যে ওকালতি করে যতীন মুখুজ্যে ইতিমধ্যেই দুটি দোতলা ও তিন-চারটি একতলা বাড়ি বানিয়েছেন। তাছাড়া উনি জুড়িগাড়ি চড়ে কোর্টে যান। বাঙালীটোলার কালীমন্দির তৈরির জন্য উনি পাঁচশ এক টাকা দান করে বাঙালী সমাজের সর্বজনস্বীকৃত নেতা বলে বিবেচিত হন। এছাড়া ডাঃ নগেন্দ্রবিজয় বাঙ্গালী ঘোড়ায় চড়ে রুগী দেখতে যান ও নগদ দুটাকা ফী পান বলেও কম সম্মানিত না। এমনি আরও কয়েকজন আছেন।