হঠাৎ উনি প্রশ্ন করেন, তুমি কি ঝণ্টুবাবুর কাজ ছেড়ে দিয়েছিলে?
ছেড়ে দেব না? বৃদ্ধ রিক্শাওয়ালার সুরই বদলে গেল। বলল, সাব, বলতে শরম হয়।
শরম লাগলেও ও থামে না। বলে, একদিন রাত্রে শরাব খেয়ে উনি আমার বিবির ইজ্জত নষ্ট করতে আসেন।
সুবোধবাবু মুখ বিকৃত করে অজান্তেই বলেন, ইস!
…সাব, তখন আমি জোয়ান বেটা! বিবিও জোয়ান লেড়কী। কোন বাল-বাচ্চাও হয়নি। ঝণ্টুবাবুর ঐ কাণ্ড দেখে আমার মাথায় খুন চড়ে গেল। ভুলে গেলাম উনি আমার মালিক আছেন। হাতের কাছেই একটা বাঁশ পেয়ে আমি দমাদম ওঁকে পেটাতে শুরু করি।
ও একবার নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলে, তারপর ঝন্টুবাবুর হুকুমে দুটো দারোয়ান চাবুক দিয়ে মারতে মারতে আমাকে আধমরা করার পর…
বল কী?
রিকশা চালাতে চালাতেই ও মুহূর্তের জন্য পিছন ফিরে বলল, ভগবান কী কসম সাব! সব সাচ হ্যায়।
তুমি কিছু বললে না?
আমি গরীব অদমী। আমি কি বলব? ও বোধহয় একটু হাসে। বলে, সাব, ঝণ্টুবাবু সেদিন রাত্রে আমাকে আর আমার বিবিকে নাংগা করে বের করে দেন।
শুনে সুবোধবাবুর মত শান্ত মানুষেরও রক্ত যেন টগবগ করে ফুটতে থাকে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, এ কতদিন আগেকার ঘটনা?
সাব, তখন আংরেজ জমানা। লড়াই ভী চলছিল!
উনি বুঝতে পারেন, যুদ্ধের সময়ের কথা।
হঠাৎ রিক্শাটা মোড় ঘুরে ঢালু রাস্তায় এসে খুব জোরে ছুটতে শুরু করল কিন্তু বেশি দূর যাবার আগেই রিকশাওয়ালা ব্রেক কষে একটা বিরাট দোতলা বাড়ির সামনের মাঠে ঢুকল।
এই কি রাজাবাবুর বাড়ি?
হাঁ সাব!
গাড়িবারান্দার নিচে রিকশা থামতে না থামতেই মহেন্দ্রবাবু প্রায় ছুটে এসে অভ্যর্থনা করলেন, আসুন, আসুন।
ছোট্ট সুটকেসটা পাশে নামিয়ে রেখেই রিকশাওয়ালা দু হাত জোড় করে মহেন্দ্রবাবুকে বলল, প্রণাম সাহাব।
হাজার হোক রাজাবাবুর বংশধর! একজন তুচ্ছ রিকশাওয়ালার দিকে মুহূর্তের জন্য নজর দেওয়াও বোধহয় অমার্জনীয় অপরাধ। তাই মহেন্দ্রবাবু ওর কথায় কান দিলেন না।
সুবোধবাবু রিকশা থেকে নামার আগেই দুটো টাকা রিকশাওয়ালার দিকে এগিয়ে দিতেই মহেন্দ্রবাবু হঠাৎ যেন ক্ষেপে উঠলেন, আহা হা! মোটে ষাট পয়সা ভাড়া।
সুবোধবাবু একটু হেসে বললেন, আমি অর্থনীতির অধ্যাপক। আমি জানি কতটুকু পরিশ্রম করলে কি পারিশ্রমিক পাওয়া উচিত। এবার উনি রিকশাওয়ালার হাতে দু-টাকার নোটটি গুঁজে দিয়ে বললেন, আমি দিচ্ছি। তুমি রেখে দাও। সাহেব একটুও রাগ করবেন না।
কন্যার বিয়ের ব্যাপার না হলে মহেন্দ্রবাবু নিশ্চয়ই এত বড় অন্যায় বরদাস্ত করতেন না। উনি বেশ গর্বের সঙ্গেই বললেন, আগে কোন গাড়ি-ঘোড়া এ বাড়িতে ঢুকলে ধন্য মনে করত। জোর করলেও কেউ ভাড়া নিত না।
একজন চাকর সুটকেসটি নিয়ে প্রায় দৌড়ে দোতলায় উঠল।
মহেন্দ্রবাবু সম্মানিত অতিথিকে নিয়ে ধীর পদক্ষেপে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেন, এই রিকশাওয়ালা হারামজাদাই এক কালে আমার বাবাকে দুবেলা মালিশ করত।
আচ্ছা?
হ্যাঁ সুবোধবাবু!
২. সুবোধবাবু এ বাড়িতে পা দিয়েই
সুবোধবাবু এ বাড়িতে পা দিয়েই খেয়াল করেছেন, এককালে এ বাড়ির সিঁড়ি ও মেঝে ইটালিয়ান মার্বেল দিয়ে মোড়া ছিল। এখনও যে নেই, তা নয়। মেঝের সর্বত্র না হলেও অনেক জায়গাতেই আছে কিন্তু সিঁড়িতে প্রায় নেই বললেই চলে। তাদের শূন্যস্থান পূর্ণ হয়েছে সিমেন্ট-বালি দিয়ে। গরমের দিনে মুখে পাউডার মাখার মত কোন কোন জায়গায় ঐ সিমেন্ট-বালির উপর একটু সাদাঁ সিমেন্টের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। গ্রাম্য যাত্রার দলে পুরুষ নর্তকী যেমন বেমানান, তেমনই বীভৎস?
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই সুবোধবাবু প্রশ্ন করেন, আচ্ছা মহেন্দ্রবাবু, এ বাড়ি কতদিনের হল?
তা একশ বছরের উপর হল। মহেন্দ্রবাবু পাশ ফিরে ওঁর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলেন, আঠারোশ উনষাট সালে আমার গ্রেট গ্র্যাণ্ড-ফাদার ইংরেজদের কাছ থেকে প্রথম জমিদারী পান।…
তার মানে সিপাহী মিউটিনির পর পরই?
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন।
সুবোধবাবু আর কোন প্রশ্ন না করলেও রাজাবাবুর বংশধর ওঁদের একদা গৌরবের কাহিনী বলে যান, ঐ জমিদারী পাবার পর আমার গ্র্যাণ্ডফাদার রাজা অবলাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বিহার-উত্তরপ্রদেশের সাতটি বড় বড় শহরে সাতটি প্যালেস তৈরী করেন।…
এত কথা শোনার পর কি চুপ করে থাকা উচিত?
নিতান্ত সৌজন্যের জন্য সুবোধবাবু বলেন, আচ্ছা?
এবার মহেন্দ্রবাবু একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বলে, ঐ সাতটি প্যালেসের মধ্যে এইটি সবচাইতে ছোট!
সুবোধবাবুও একটু হাসেন। বলেন, আপনার গ্রেট গ্র্যাণ্ড ফাদারের রুচি ও মেজাজ দেখছি সত্যি রাজামহারাজের মতই ছিল।
সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। উনি একটু থেমে, একটু হেসে বলেন, আপনি খাওয়া-দাওয়ার পর বিশ্রাম করুন। তারপর ওঁর গল্প শোনাব।
দোতলার বিরাট বারান্দায় পা দিয়েই সুবোধবাবু বললেন, এবার আর ওঁর গল্প শোনা হবে না
কেন? আপনি কি ইন্টারেস্টেড না?
না, না, তা না। আমি আজ বিকেলের গাড়িতেই চলে যাব।…
এ কথা শুনেই মহেন্দ্রবাবু যেন চমকে উঠলেন। থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, না, না, তা কখনোই হতে পারে না। আপনাকে অন্তত দুচারদিন থাকতেই হবে।
বারান্দা দিয়ে এগুতে এগুতেই সুবোধবাবু অত্যন্ত ধীর স্থিরভাবে বললেন, না মহেন্দ্রবাবু, এ যাত্রায় দয়া করে আমাকে যেতে দিন। কাল কলকাতায় আমার অনেক কাজ।