সেকি আমি জানি না? মোসাহেবীর সুরে মহেন্দ্রবাবু মন্তব্য করেন।
এই আদুর বাবা কলকাতায় গবরমেন্টের কলেজে সব চাইতে বড় প্রফেসার ছিলেন। রিটায়ার করার দশ-বারো বছর আগে প্রিন্সিপ্যাল হন। এই আদু তো কত বছর বিলেতে থেকে পড়াশুনা করেছে!…
সুবোধবাবু একটু হেসে বলেন, মেজ মাসী, বাবার বা আমার কথা বলে কি হবে? আসলে পাত্রটিকে যদি ওঁদের পছন্দ হয়…
মহেন্দ্রবাবু গগদ হয়ে বললেন, কি যে বলেন আপনি?
মেজ মাসী একটু শাসন করার ভান করে বলেন, আঃ! আমাকে বলতে দে। এবার উনি রাজা অবলাকান্তর নাতির দিকে তাকিয়ে বলেন, শোন মহিম, আদুর ছেলেও বিলেত থেকে পাস করে এসেছে। হীরের টুকরো আমার নাতি! যেমন রূপ, তেমন গুণ!
বাপ-ঠাকুর্দার মতই..
ডাক্তার অঘোরনাথ চৌধুরীর দ্বিতীয়া কন্যা যোগমায়া দেবীর এই একটি রোগ! বড্ড কথা বলেন। শুধু তাই নয়। অন্য কাউকে কথা বলার সুযোগও দেন না। মহেন্দ্রবাবুকে আবার বাধা দিয়ে বললেন, ও ছেলে বাপ-ঠাকুর্দার চাইতে অনেক বেশী নাম করবে। বাপ-ঠাকুর্দা আর কখানা বই লিখেছে? ঐ কচি ছেলে এর মধ্যেই পাঁচ-সাতটা মোটা মোটা বই…
সুবোধবাবু একটু সংশোধন করে দেন, না মেজ মাসী, বাবুলের মাত্র দুটো বই বেরিয়েছে।
ঐ একই ব্যাপার! এই বয়সেই যদি মোটা মোটা দুটো বই লিখে থাকে, তাহলে…
যাই হোক ঐ রাঁচীতে মহেন্দ্রবাবুর সঙ্গে সুবোধবাবুর আলাপ হয়। যোগমায়া দেবী পূজা করতে গেলে মহেন্দ্রবাবু সবিনয়ে নিবেদন করেন, পারিবারিক ব্যাপারে বেশী আর কি বলব? তবে আমার ঠাকুর্দা বিহার-উত্তরপ্রদেশের প্রবাসী বাঙালীসমাজে সত্যি গণ্যমান্য পুরুষ ছিলেন। আর আমি সামান্য উকিল..
সামান্য কেন হবেন? সুবোধবাবু একবার ওঁর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে একটু হেসে বলেন, আপনাকে দেখে তো স্যার আশুতোষের কথা মনে পড়ে যায়।
কি যে বলেন!
আপনার কটি সন্তান?
আমার তিনটি কন্যা। বড় মেয়েটির বিয়ে দিয়েছি বছর দুয়েক আগে। আমার দ্বিতীয় কন্যাটি এই বছরই এম. এ. পাস করল।
বাঃ! শিক্ষাবিদ সুবোধবাবু শুনে খুশিই হন।
এবং শুনে খুশি হবেন, ফার্স্ট ক্লাসই পেয়েছে।
খুব ভাল।
মহেন্দ্রবাবু আরও অনেক কথা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু সুবোধবাবু বললেন, অত কিছু বলার প্রয়োজন নেই। মোটামুটি শিক্ষিতা ও সুন্দরী মেয়েই আমরা চাই।
উনি এবার নিজের পুত্রের বিষয়ে বলেন, হাজার হোক আপনি মেয়ের বিয়ে দেবেন। নিশ্চয়ই পাত্রকে ভাল করে দেখে-শুনে নেবেন।…
অত দেখাশুনার কি আছে? পিসীর কাছে যা শুনলাম…
উনি যাই বলুন, আপনি না দেখেশুনে একটি ছেলের হাতে অমন ভাল মেয়েকে তুলে দেবেন কেন। সুবোধবাবু একটু থেমে বলেন, আমার ছেলেটি স্বাস্থ্যবান এবং সুপুরুষও বলতে পারেন। ও প্রেসিডেন্সি থেকে পাস করে এল-এস-ই থেকে মাস্টার্স করেছে।
এল-এস-ই মানে?
প্রশ্ন শুনে সুবোধবাবু একটু দুঃখই পান। তবে সঙ্গে সঙ্গে বলেন, লণ্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স।
ও!
এখন জে-এন-ইউ তে পড়ায়। মাইনে—
জে-এন-ইউ তে কী?
ওঃ! সরি! জে-এন-ইউ মানে দিল্লীর জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি।
আচ্ছা! আচ্ছা!
এল-এস-ই এবং জে-এন-ইউ সম্পর্কে ভদ্রলোকের প্রশ্ন শুনেই সুবোধবাবু স্পষ্ট বুঝলেন, ওঁদের পারিবারিক ঐতিহ্যের গঙ্গা এখনও প্রবাহিত থাকলেও শিক্ষাদীক্ষারা ধারা ফল্গুর মতই বিলুপ্ত! বি. এ. এম. এ. পাস করলেই কি শিক্ষিত বা সংস্কৃতিবান হওয়া যায়?
যাই হোক রাঁচীতে আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সুবোধবাবু দিল্লী রওনা হবার আগে ওঁকে চিঠি দেন, আপনার পত্রের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আমার মা ও তার নাতি যাকে পছন্দ করবেন, তাকেই পুত্রবধূ করে ঘরে আনব কিন্তু আপনারা দূরের বাসিন্দা বলে ওরা দুজনেই আমার উপর প্রাথমিক নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়েছেন
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি আঞ্চলিক সেমিনারে যোগ দেবার জন্য আমি আগামী সোমবার দিল্লী যাচ্ছি। পনেরই পর্যন্ত সেমিনার চলবে। দিল্লীতে আমারও কিছু কাজ আছে। তাছাড়া পুত্রের আগামী বইটির পাণ্ডুলিপিও পড়তে হবে। যাইহোক মোটামুটি কুড়ি বাইশ তারিখ নাগাদ দিল্লী থেকে রওনা হয়ে আপনাদের ওখানে আসব বলে মনস্থির করেছি। ইচ্ছা আছে, একবেলা আপনাদের কাছে থেকেই কলকাতা রওনা হব। এখানে আমার অনেক কাজ।
সেই সুবাদেই সুবোধবাবু বহু প্রবাসী বাঙালীর উজ্জ্বল স্মৃতি বিজড়িত এই শহরে এসেছেন।
বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা রিকশার প্যাডেল ঘুরোতে ঘুরোতেই আপন মনে একটু হেসে বলে, ঝণ্টুবাবু বহুত মজাদার আদমী ছিলেন। ইয়ার-দোস্তদের নিয়ে লাচ-গান শোনার জন্য উনি কত রুপেয় খরচা করতেন।
সুবোধবাবু একটু হাসেন।
ও একটু থেমেই বেশ গর্বের সঙ্গে বলে, জানেন সাব, ঝন্টুবাবুর শরাব বিলাইত থেকে আসত।
উনি একটু উৎসাহ দেবার সুরেই বলেন, সত্যি?
আরে সাব, আমি কি আপনাকে ঝুট বলব? এ শহরের সবাই ওঁর কথা জানে।
এদিক-ওদিক ঘুরে-ফিরে রিক্শা এগিয়ে চলে। রিকশাওয়ালা আপন মনেই বলে যায়, আরে সাব, রহিশ আদমীদের কারবারই আলাদা! ঝণ্টুবাবুর দুটো বিবি ছিল, দু-তিনটে আওরাতকেও উনি রেখেছিলেন। এছাড়া লক্ষ্ণৌ-কাশী থেকেও বাইজী এনে কয়েক মাস নিজের কাছে রাখতেন।
শুনেই সুবোধবাবুর সারা শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে। রাগও হয়। একবার মনে মনে ভাবেন, যে পরিবারে ঝণ্টুবাবুর মত সুসন্তান জন্মেছেন, সেই পরিবারের মেয়েকে উনি পুত্রবধূ করে ঘরে আনতে পারেন না। আবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, যে কোন বড় পরিবারেই এ ধরনের দু-একটি রত্ন থাকতেই পারে কিন্তু তাদের জন্য নিরপরাধ বংশধররা শাস্তি পাবে কেন?