বলবে মানে সন্দেহ করবে।
কী আবার সন্দেহ করবে?
মলিনা প্রথমে বলতে চায় না কিন্তু ইন্দ্ৰকান্ত কয়েকবার অনুরোধ করার পর অত্যন্ত দ্বিধা ও কুণ্ঠার সঙ্গে বলে, সবাই সন্দেহ করবে আমি আপনাকে ভালবাসি।
এবার ইন্দ্ৰকান্ত একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে খুব চাপা গলায় জিজ্ঞেস করে, কেন, তুমি আমাকে ভালবাসো না?
মলিনা শুধু মাথা নেড়ে জানায়, হ্যাঁ।
ইন্দ্ৰকান্ত সঙ্গে সঙ্গে ডানহাত দিয়ে ওর মুখখানি আলতো করে একটু তুলে ধরে বলে, তোমাকেও আমার খুব ভাল লাগে।
আনন্দে গর্বে কৃতজ্ঞতায় মলিনা প্রায় আত্মহারা হয়ে যায়। মনে মনে একটু ভয়ও হয়, দ্বিধা করে। বলে, আমার মত সামান্য মেয়েকে আপনার কখনও ভাল লাগতে পারে না।
হঠাৎ ইন্দ্ৰকান্ত দুহাত দিয়ে ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলে, সত্যি মলিনা, তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে।
সে রাত্রে মলিনা দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। স্বপ্ন দেখে, সানাই বাজছে, রাজবাড়ি আলোয় আলো, কত শত-সহস্র অতিথির আগমন হচ্ছে, অসংখ্য দাস-দাসীর দৌড়াদৌড়ি, স্বয়ং অবলা কান্ত ওকে আশীর্বাদ করছেন, বিন্দুবাসিনী স্নেহচুম্বন দিয়ে কোলে তুলে নিয়েছেন।
আরও কত কি ভাবে। রাত কাটতে না কাটতেই সেই পরম আকাঙ্ক্ষিত তিথি, সেই অনুপম মাধুরী রাত। মদির দৃষ্টিপাতেই কী রোমাঞ্চ! স্পর্শে? আশ্চর্য শিহরণের ঢেউ বয়ে যাবে শরীর দিয়ে।
তারপর?
ধীরে ধীরে, তিলে তিলে মহানন্দে আত্মসমর্পণ। যৌবন-মানস সরোবরে দ্বৈত অবগাহন।
তোমার কী শরীর খারাপ?
মলিনা মাথা নেড়ে বলে, না।
ইন্দ্ৰকান্ত প্রশ্ন করে, তবে তোমাকে দেখে ক্লান্ত লাগছে কেন?
মলিনা মুখ নিচু করে একটু হেসে বলে, কাল সারারাত শুধু আপনার কথাই ভেবেছি। এক মিনিটের জন্যও দুটো চোখের পাতা এক করতে পারিনি।
এবার ইন্দ্ৰকান্ত একটু হেসে বলে, তুমি তো শুধু কাল সারারাত আমার কথা ভেবেছ কিন্তু আমি যে বহু রাত জেগেই তোমার কথা ভাবছি।
সত্যি?
আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?
না, না, তা কেন বিশ্বাস করব না? কিন্তু
কিন্তু কী?
আমার মত সামান্য মেয়েকে নিয়ে আপনার এত ভাবনা-চিন্তা করা কী ঠিক হচ্ছে?
ইন্দ্ৰকান্ত আবার একটু হেসে বলে, মলিনা, ভালবাসার এই তো বিপদ!
শুধু শ্রবণে বা গন্ধে-স্পর্শে কী কামিনীরঞ্জনের নাতির মন ভরে?
ঘরে ঘরে ইন্দ্ৰকান্তর সঙ্গীত শিক্ষার আসর সত্যি বড় বেশী জমে উঠেছিল কিন্তু হঠাৎ বনবিহারী মুখুজ্যের নাতনী যোগমায়ার সঙ্গে তার সঙ্গীত শিক্ষক ইন্দ্ৰকান্তর বিয়েতে সবাই চমকে উঠলেন। তাছাড়া বিয়ের দুদিনের মধ্যে নবদম্পতি সুদূর রাজপুতানায় চলে যাওয়ায় সারা বাঙালীটোলায় গুঞ্জন উঠল। কেউ কেউ সরাসরি বনবিহারীবাবুকেও জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার হে বনবিহার, হঠাৎ ওদের বিয়ে, হঠাৎ ওদের উধাও হয়ে যাওয়া কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে।
বনবিহারী গড়গড়া টানতে টানতে বলেন, ওরে বাপু, নাতনীকে দেখে হঠাৎ অবলাকান্তর পছন্দ হল বলেই হঠাৎ বিয়ে হল। এতে আর অবাক হবার কী আছে?
কিন্তু বিয়ের পর পরই ওরা এমন করে শহর ছেড়ে গেল বলেই নানাজনে নানা কথা বলছে।
বনবিহারীবাবু বেশ গম্ভীর হয়েই বলেন, যারা নানা কথা বলাবলি করছে তারা তো জানেন যে রাজপুতানাতেও ওদের অনেক সম্পত্তি আছে। তাছাড়া ওখানে এক ওস্তাদের কাছে নাতজামাই গান শিখবে।
পাড়ার লোকজন এই কৈফিয়ত শুনে ঠিক খুশি হয় না।
বনবিহারীবাবু বলেন, ওরে বাপু, ইন্দ্ৰকান্ত তো আমার নাতনীকে নিয়ে পালিয়ে যায়নি। রীতিমত বৈদিক মন্ত্র পাঠ করে সাতপাক ঘুরে বিয়ে করেছে।
উনি একটু দম নিয়ে বলেন, আসলে নাতজামাইয়ের প্রতি অনেকেরই লোভ ছিল। আমার নাতনীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলে অনেকেই তাই হিংসায় জ্বলে-পুড়ে মরছেন।
বনবিহারীবাবু যাই বলুন না কেন, বাঙালীটোলার সবাই বুঝলেন, কান কেলেঙ্কারী ধামাচাপার জন্যই এমন তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হবার পরই ওরা রাজপুতানা চলে গেছে।
নিশিকান্ত ও শ্রীকান্তকে নিয়েও অবলাকান্ত ও তার স্ত্রী বিন্দু বাসিনীর অশান্তির শেষ নেই। তাই তো কিছুদিনের জন্য নিশ্চিন্তে থাকার আশায় ওরা দুজনে একদিন কাশী যাত্রা করলেন।