কিন্তু তাই বলে এত দামী গরদ?
না, না মাসিমা, এসব কথা বলে লজ্জা দেবেন না। সুধাময়ের মত আমিও তো আপনার এক ছেলে!
আহা হা! কি কথা! বৃন্দাবন-পত্নী আনন্দে গর্বে প্রায় কেঁদে ফেলেন আর কী! বলেন, সে তো একশ বার বাবা। তোমার মত ছেলে পেটে ধরতে পারলে তো ধন্য হয়ে যেতাম।
শুধু সুধাময়ের মা না, সব শিষ্যের মা-রাই এখন ইন্দ্রনাথের শ্রদ্ধাভক্তি ও ব্যবহারে মুগ্ধ। ওদের সবার বাড়িতেই ইন্দ্রনাথের অবাধ গতি।
…এই যে শোভা, মুকুন্দ আছে?
এমন অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যে শোভা চমকে ওঠে। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে মুহূর্তের জন্য ইন্দ্ৰকান্তর দিকে তাকিয়ে বলে,
না, দাদা তো নেই।
ইন্দ্ৰকান্ত একটু গম্ভীর হয়ে কি যেন চিন্তা করে বলে, একটু দরকার ছিল। আচ্ছা
আপনি চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
দাঁড়ান, দাঁড়ান, মাকে ডাক দিই।
আবার ওঁকে কষ্ট দেবার কী দরকার? তাছাড়া উনি নিশ্চয়ই কাজকর্মে ব্যস্ত আছেন।
না, না, আপনি বসুন। আমি মাকে ডাকছি। শোভা প্রায় দৌড়ে ভিতরে যায়।
এক মিনেটের মধ্যেই মুকুন্দর মা এসে বলেন, তুমি দাঁড়িয়ে কেন বাবা? আগে বসো।
মুকুন্দ যখন নেই…
সে নেই বলেই তুমি চলে যাবে? আমরা কী কেউ না?
সেই শ্রদ্ধা, বিনয়ের সঙ্গে ইন্দ্ৰকান্ত বলে, আমি তো তা বলিনি মাসিমা।
একটু মিষ্টিমুখ না করেই তুমি চলে যাবে, তাই কী হয়?
আবার মিষ্টিমুখ…
না, তুমি বাবা বসো। এবার উনি মেয়েকে বলেন, শোভা, ইন্দ্রকান্তকে বাতাস কর।
উনি সঙ্গে সঙ্গেই ভিতরে চলে যান। শোভা ভিতর থেকে ঝালর দেওয়া একখানা হাতপাখা এনে বাস করতেই ইন্দ্ৰকান্ত একটু হেসে বলে, না না, হাওয়া করতে হবে না। তুমি বসো।
শোভা মৃদু প্রতিবাদ করে, না না, শুধু শুধু বসে থাকব কেন?
হ্যাঁ, তুমি শুধু শুধুই বসে থাকবে। আমি তোমাকে দেখব।
আনত নয়নে শোভা বলে, আমাকে আবার কী দেখবেন?
কী দেখব মানে? তোমার মত সুন্দরী মেয়ে এশহরে আর কে আছে?
শুনে আনন্দে গর্বে শোভার বুক ভরে উঠে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় সারা মুখ লাল হয়ে যায়। ওর মুখ দিয়ে আর কথা বেরোয় না।
ইন্দ্ৰকান্তই আবার কথা বলে, তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে। ইচ্ছে করে তোমার সঙ্গে গল্প করি, তোমাকে গান শেখাই…
আমারও গান খুব ভাল লাগে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
বেশ তো, আমি তোমাকে শেখাব।
কিন্তু বাঙালীটোলার কোন মেয়ে তো গান শেখে না। আমি গান শিখলে যদি কিছু বলে?
ইন্দ্ৰকান্ত অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তির মত বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলে, কী আর বলবে? তুমি তো চুরি করছ না?
না, তা না কিন্তু…
রবিবাবু যদি তার বীরভূমের আশ্রমে মেয়েদের গান শেখাতে পারেন, তাহলে তুমি আমার কাছে গান শিখলে দোষ কী?
অকাট্য যুক্তি।
এক থালা ফল-মিষ্টি নিয়ে মুকুন্দর মা ঘরে ঢুকতেই ইন্দ্ৰকান্ত বলল, মাসিমা, আমি শোভাকে গান শেখালে আপনাদের কোন আপত্তি নেই তো?
প্রস্তাব শুনেই উনি বিস্মিত হন। মুহূর্তের মধ্যে বাঙালীটোলায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে নেন কিন্তু সরাসরি প্রত্যাখ্যান, নাকচ করতে সাহস হয় না। বলেন, সে তো সৌভাগ্যের কথা কিন্তু বাবা, বাঙালীটোলার মানুষদের তো তুমি চেনো…
গান শেখা তো কোন অন্যায় না মাসিমা? তাছাড়া আমি তো কোন পেশাদারী গাইয়ে না।
সে কী আর আমি বুঝি না বাবা! তবু একবার ওর বাবার সঙ্গে কথা বলে নেব।
মেসোমশায়ের মতামত তো নিতেই হবে। তিনি অনুমতি না দিলে তো আমিও শেখাব না।
শোভাই প্রথম, কিন্তু বছর খানেক ঘুরতে না ঘুরতেই বাঙালীটোলার পাঁচ-ছটি ঘর থেকে হারমোনিয়ামের আওয়াজ সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। শিষ্যরা মাঝে মাঝে অনুযোগ করে, ওস্তাদ! তুমি আজকাল আমাদের দিকে নজর দিচ্ছ না।
আমাকে পছন্দ না হলে তোমরা অন্য কোন ভাল ওস্তাদের কাছে শিখতে পারো।
ওরা সবাই এক সঙ্গে প্রতিবাদ করে, না না, ওস্তাদ, তোমার কাছে ছাড়া আর কারুর কাছে আমরা গান শিখব না।
ইন্দ্ৰকান্ত ওদের বিনোদন ব্যবস্থা আরও একটু উন্নত করতেই সব শিষ্যরা চুপ। তাছাড়া ইতিমধ্যে ইন্দ্ৰকান্ত শিষ্যদের নিয়ে মুঙ্গেরের বাঈজীর কাছে গিয়ে সারারাত ধরে ঠুংরী শোনার পর তো শিষ্যরা ওর গোলাম হয়ে গেল।
মেয়েদের গান শেখা নিয়ে বাঙালীটোলায় গুঞ্জন উঠলেও তা বাইরে আত্মপ্রকাশ করল না। তার একমাত্র কারণ ইন্দ্ৰকান্ত। সারা পাড়ার সব বাড়িতেই ওর যাতায়াত, সবার সঙ্গেই ওর ভাব। তাছাড়া গুরুজনদের প্রতি ও সব সময় শ্রদ্ধাশীল ও কথাবার্তায় অত্যন্ত বিনয়ী।
ইন্দ্ৰকান্ত অত্যন্ত বুদ্ধিমান বলেই সব মেয়েকেই দু-একটা কীর্তন বা শ্যামাসঙ্গীত শিখিয়েছিল। ওরা মাঝে মাঝে বুড়ো-বুড়ীদের সেসব গান শোনাত বলে সারা পাড়ায় ইন্দ্ৰকান্তর জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে গেল।
একদিন মলিনা কথায় কথায় বলল, জানেন ইন্দ্ৰকান্তদাদা, সবাই আপনার প্রশংসা করে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। মলিনা একটু থেমে বলে, আপনার প্রশংসা শুনতে আমার খুব ভাল লাগে।
কেন?
ও মুখ নিচু করে বলে, তা বলতে পারব না কিন্তু সত্যি আমার ভাল লাগে।
কিন্তু তুমি তো আমার প্রশংসা কর না।
মলিনা মুহূর্তের জন্য ওর দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি গুটিয়ে নিয়ে বলে, আমি প্রশংসা করলে যে লোকে নানা কথা বলবে!
ন্যাকামি করে ইন্দ্রকান্ত জিজ্ঞেস করে, লোকে আবার কী বলবে?