কী যে বলেন আপনি? ফাদার বারোজকে জিজ্ঞেস করবেন, আমি কী দারুণ ফুটবল খেলি।
আচ্ছা?
সূর্যকান্ত বেশ গর্বের সঙ্গেই বলে, হ্যাঁ, উনিই তো আমাকে বলেছেন, আমি মোহনবাগানে চান্স পাবই।
অবলাকান্ত একটু মৃদু হেসে বলেন, বাঃ! বড়ই আনন্দের কথা। এবার উনি নিজেকে দেখিয়ে বলেন, তাহলে এই বাঙালী ফাদারকে বিরক্ত না করে তোমার ঐ সাহেব ফাদারকেই বল টাকাকড়ি দিতে। প্রায় এক নিঃশ্বাসেই উনি বলেন, যাও, বিরক্ত কর না।
হাজার হোক কামিনীরঞ্জনের নাতি। যাও বললেই কী চলে যায়? কত ঝগড়া-বিবাদ চিৎকার-চেঁচামেচি জিনিসপত্র ভাঙাচুরো করে শেষ পর্যন্ত সূর্যকান্ত সত্যি সত্যি হাজার হাজার টাকা নিয়ে কলকাতা গেল। কলকাতায় যাবার পরও শান্তি কী আছে? শেষ পর্যন্ত কেচ্ছা কেলেঙ্কারী!
দ্বিতীয় পুত্র চন্দ্রকান্ত বেশ ভদ্র-সভ্য থাকলেও হঠাৎ একদিন তার মাথায় ভূত চাপল, উনি কবি হবেন। কার কাছ থেকে শুনেছিল, রবিবাবু পদ্মার উপর সুন্দর বাহারী নৌকায় বসে কাব্য রচনা করেন। ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে তিনি পিতৃদেবের কাছে আবেদন পেশ করলে, বাবা, আমিও গঙ্গায় চাঁদনী রাতে বোটে বসে কাব্য রচনা করব।
অবলাকান্ত না হেসে পারলেন না। বললেন, অতি সাধু প্রস্তাব কিন্তু বাবা, চাঁদের আলো তো আমাদের বারান্দায়, বাগানেও ছড়িয়ে পড়ে। সে সব জায়গায় বসে কাব্য রচনা হয় না?
তাহলে আর রবিবাবু জোড়াসাঁকোর প্রাসাদ ছেড়ে পদ্মার বুকে ভেসে বেড়াতেন না।
অকাট্য যুক্তি! লুকিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলেন, তা বাবা কতদিন তুমি গঙ্গার বুকে ভেসে বেড়াবে?
যতদিন ভাল লাগে।
বাঃ! কিন্তু বাবা, আকাশে তো সব সময় চাঁদ থাকে না। চাঁদমামা পনেরো দিন ডিউটি দিয়ে পনেরো দিন ছুটিতে থাকেন। তখন তুমি কী করবে?
অত ভাবিনি।
অত না ভাবলে তো তোমাকে আমি রবিবাবু তৈরি করতে পারব না।
এবার ভাবী কবিও ফোঁস করে ওঠে। বলে, এই জমিদারীতে আমারও অংশ আছে।…
না, অবলাকান্ত আর সহ্য করতে পারেন না। দপ করে জ্বলে ওঠেন। বলেন, বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। গলা টিপলে দুধ বেরুবে আর এরই মধ্যে উনি জমিদারীর অংশ নিয়ে কথা বলছেন।
ভাবী কবি মুহূর্তের মধ্যে অবলাকান্তের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গেলেও কয়েক ঘণ্টা পর স্বয়ং কালেক্টর সাহেবকে নিয়ে ফিরে এল।
ছি, ছি, সে কী কেলেঙ্কারী! বিচক্ষণ কালেক্টর সাহেব পিতা পুত্র দুজনকেই অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেন কিন্তু কোন ফল হল না। শেষ পর্যন্ত নগদ বিশ হাজার টাকা, বেশ কিছু জমিজমার দলিল ও যথেষ্ট গহনাপত্র নিয়েই হবু কবি চন্দ্রকান্ত গৃহত্যাগ করলেন।
এখানেই নাটক শেষ হল না। পরদিন ভোরেই সারা বাঙালীটোলার ঘরে ঘরে আগুনের মত খবর ছড়িয়ে পড়ল, রাজবাড়ির গৃহ শিক্ষক আশু লাহিড়ীর মেয়ে লতাকে নিয়ে দ্বিতীয় কুমার সাহেব শহর ছেড়ে উধাও হয়েছে। এ দুঃসংবাদ অবলাকান্তর কানে পৌঁছতেই উনি আশুবাবুকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, যা শুনছি তা কি সত্যি?
আজ্ঞে, আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।
ন্যাকামী না করে সোজাসুজি বলুন, আপনার মেয়ে আমার ছেলেকে নিয়ে পালিয়েছে কিনা।
আজ্ঞে না।
আজ্ঞে না মানে? সারা বাঙালীটোলার মানুষ যে কথা জানে আর আপনি…
আশুবাবু নিজে শিক্ষকতা করলেও ওঁদের বংশের সবাই ওকালতি করেন। জমিদার না হলেও প্রচুর ভূসম্পত্তির মালিক ওঁরা। ছোট খাট যুদ্ধ-বিগ্রহ করার অভ্যাস ভালই আছে। তাই উনি অবলাকান্তকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বললেন, আজ্ঞে বাঙালীটোলায় যে খবর রটেছে, তা ঠিকই কিন্তু আমার মেয়ে আপনার ছেলেকে নিয়ে উধাও হয়নি…
এবার অবলাকান্তর মুখ দিয়ে ইংরাজি গালাগালি বেরোয়, ননসেন্স।
আজ্ঞে আমাকে কথাটা শেষ করতে দিন। আসলে আপনার ছেলেই আমার মেয়েকে নিয়ে উধাও হয়েছে।
অবলাকান্ত অনেক তর্জন-গর্জন করলেও আশুবাবু বিন্দুমাত্র উত্তেজিত হলেন না। অত্যন্ত ধীর-স্থিরভাবে জমিদারবাবুকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ওসব বারেন্দ্র-রাঢ়ী নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে লাভ নেই।
কেন? কেন?
ওরা আর হিন্দু নেই। ব্রাহ্ম হয়েই ওরা বিয়ে করেছে।
কথাটা শুনেই শান্তকাল বৈশাখীর মত অবলাকান্ত ফেটে পড়লেন কিন্তু হাতের পাখী বনে উড়ে গেলে কী আর ফিরে আসে?
শুধু সূর্যকান্ত ও চন্দ্রকান্তকে নিয়েই অশান্তি না। অন্য তিন পুত্র ইন্দ্ৰকান্ত, নিশিকান্ত ও শ্রীকান্তকে নিয়েও ওদের স্বামী-স্ত্রীর কম ঝামেলা বা অশান্তি সহ্য করতে হয়নি বা হয় না। এক একটি এক এক অবতার।
সৌখীন ইন্দ্ৰকান্ত যখন প্রথম সঙ্গীত চর্চায় আত্মমগ্ন হল, তখন বিন্দুবাসিনীই স্বামীকে বললেন, ম্যানেজারবাবু বলছিলেন, ওস্তাদজী বলেছেন, তোমার এই ছেলে গান-বাজনায় খুব নাম করবে।
আগে নাম করুক, তারপর বল। অনেক দুঃখে অবলাকান্ত একটু ম্লান হেসে বললেন, তুমি সত্যি রত্নগর্ভা!
এখন যত দোষ, নন্দ ঘোষ। তাই না? তোমার বাপ-ঠাকুর্দারা কী মহাপুরুষ ছিলেন, তা কী ভুলে গেছ? যে বাড়িতে বসে কথা বলছ, সে বাড়িটাও তো তোমার বাপের মেমসাহেব রক্ষিতার।
আঃ! চুপ কর।
দিন এগিয়ে চলে। বছরের পর বছর ঘুরে যায়। প্রিয় শিষ্যের সঙ্গীত বিদ্যায় অভূতপূর্ব উৎসাহ ও নিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে ওস্তাদজী পাত তাড়ি গুটিয়ে রামপুর ফিরে গেছেন। কুমার ইন্দ্ৰকান্ত এখন নিজেই ওস্তাদ। বাঙালীটোলার কিছু রসিক ছোকরা তার একান্ত ভক্ত শিষ্য। রোজ সন্ধ্যেয় আসর বসে, চলে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত। তবে খেয়াল-ঠুংরীর চর্চার চাইতে খামখেয়ালী করেই সময় কাটে। ওস্তাদজীর অনুপ্রেরণায় ও সক্রিয় সাহায্যে শিষ্যরাও একটু-আধটু পান করেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত চর্চা করতে হলে ওটা নাকি অত্যন্ত জরুরী। বাঙালীটোলায় শিষ্যদের বাড়িতে বাড়িতে চাপা গুঞ্জন, মৃদু প্রতিবাদ, মাঝে মাঝে অশান্তি কিন্তু কোন ফল হয় না। ওস্তাদজীর চাইতে শিষ্যদেরই বেশি উৎসাহ, উদ্দীপনা। কখনও কখনও ওস্তাদজীও শিষ্যদের বাড়িতে হাজির হয়ে নানা রাগ-রাগিণী নিয়ে আলাপ আলোচনা করেন। শিষ্যদের বাড়ির লোকজনও তাতে খুশি হন। না হবার কোন কারণ নেই। ইন্দ্ৰকান্ত যে কখনই খালি হাতে শিষ্যদের বাড়ি যান না। কিছু না হলেও এক ঝুড়ি ল্যাংড়া আর দুআড়াই সের রাজভোগ নিশ্চয়ই নিয়ে যাবেন। সম্ভব হলে আরও অনেক কিছু কিন্তু সেদিন ইন্দ্ৰকান্ত বৃন্দাবন মুখুজ্যের স্ত্রীর হাতে একখানি সুন্দর গরদের শাড়ি তুলে দিতেই উনি অবাক–একি বাবা? হঠাৎ আমাকে গরদের শাড়ি দিচ্ছ কেন? আপনি তো দিনের অর্ধেক সময় পূজার ঘরেই কাটান। তা..ইন্দ্ৰকান্ত অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে নিবেদন করে।