একবার তো উনি ভেবেছিলেন, সবার সামনেই বলবেন, যা করেছি, বেশ করেছি। আমি পুরুষ মানুষ তার উপর জমিদার। এবং স্বাস্থ্যবান ও অত্যন্ত সুদর্শন। সুতরাং যদি কোন সম্ভ্রান্ত ঘরের সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী মহিলা স্বেচ্ছায় তাকে আনন্দদান করেন, তাহলে উনি কেন প্রত্যাখান করবেন?
যাকগে। এসব নিয়ে অনেক মাথা ঘামিয়েছেন এবং স্কুলের জন্য দশ হাজার টাকা দান করার পর বাঙালীটোলার বাসিন্দাদের ধারণা হয়েছে, সুধাদেবী ও তার হতচ্ছাড়া ডেপুটি স্বামী অবলাকান্তর কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা আত্মসাৎ করার জন্যই এই ধরনের একটা নোংরা গুজব ছড়িয়ে ছিলেন। যাইহোক কালেক্টর সাহেবের অশেষ কৃপায় সব ভাল ভালয় মিটে গেছে। শেষ পর্যন্ত উনি ডেপুটিকেও সাঁওতাল পরগণায় বদলী করে দিয়েছেন। তবুও আর এখানে ভাল লাগছিল না।
কামিনীরঞ্জন মৃত্যুর কয়েক বছর আগে কাশীর বাঙালীটোলায় একটা বিরাট বাড়ি কেনেন এবং এই বাড়িটি কারুরই বিক্রির অধিকার নেই। শুধু বসবাস করার অধিকার আছে সব ছেলেমেয়ে ও তাদের বংশধরদের। তীর্থে গেলে দূর সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনরাও এখানে থাকতে পারবেন বলে কামিনীরঞ্জন উইল করে যান। বোধহয় কাশীর এই বাড়ির কথা ভেবেই অবলাকান্তের স্ত্রী বিন্দুবাসিনী দেবী বহুকাল ধরেই বলছিলেন, হ্যাঁগো, মোটরগাড়ি কেনার পর মাঝে মাঝে কয়েক দিনের জন্য দেওঘর-বৈদ্যনাথধাম যাওয়া ছাড়া আর তো কোথাও যাই না। চলো না, কিছুদিনের জন্য কোন তীর্থে ঘুরে আসি।
উনি একটু থেমেই আবার বলেন, এই ছোট্ট শহরে থাকতে থাকতে সত্যি হাঁপিয়ে উঠেছি।
অবলাকান্ত একটু হাসেন।
হাসছ যে? সত্যি, এই ছোট্ট শহরে কী করে যে এক নাগাড়ে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম, তা ভাবলেও অবাক হতে হয়।
সত্যি, অনেক বছর আমরা কোথাও যাই না।
বিন্দুবাসিনীদেবী বলেন, হতচ্ছাড়া শহরে না আছে একটা মন্দির, আছে একটা ভাল রাস্তা বা বেড়াবার জায়গা। তাছাড়া অন্নপ্রাশন থেকে বিয়ে-পৈতে-শ্রাদ্ধ যে কোন অনুষ্ঠানেই যাই না কেন, সেই বাঙালীটোলার কয়েকটা পরিচিত মুখ ছাড়া একজন নতুন মানুষের মুখও এখানে দেখতে পাই না।
অবলাকান্ত একটু হেসে বলেন, তুমি ঠিকই বলেছ। এখানে সব উৎসব-অনুষ্ঠানেই একই মানুষগুলোকে সব সময় দেখতে পাওয়া যায়।
এবার বিন্দুবাসিনীদেবী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, সব চাইতে বড় কথা ছেলেমেয়েদের ঝামেলা আর সহ্য হচ্ছে না। খুব দূরে কোথাও একলা থাকতে পারলেই বোধহয় একটু শান্তিতে থাকতে পারতাম।
অবলাকান্তও দীর্ঘনিঃশ্বাস না ফেলে পারেন না। বলেন, দুটো মেয়েকে বিয়ে দেবার পরও যে এত ঝামেলা সহ্য করতে হবে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
তা ঠিক কিন্তু তোমার ছেলেরা যে এক একটি রত্ন তৈরি হয়েছে।
অবলাকান্ত মুখ নিচু করে মাথা নাড়েন, মুখে কিছু বলেন না।
সত্যি, ছেলেমেয়েদের নিয়ে ওদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এখানে আসার পরই ওঁরা ছেলেমেয়েদের পাদ্রীদের স্কুলে ভর্তি করেন। প্রত্যেক ছেলেমেয়ের জন্যই আলাদা আলাদা গৃহ-শিক্ষক নিয়োগ করলেন কিন্তু কোন ছেলেমেয়েই না নিয়মিত স্কুলে যাবে বা বাড়িতে পড়বে। বড় পাদ্রী নিজে কতবার অবলাকান্তকে বলেছেন, রাজাবাবু, আপনার চিলড্রেনরা বহুত কামাই করে। আই আণ্ডারস্ট্যাণ্ড ওরা জমিদার বাড়ির ছেলেমেয়ে এবং আমরা ওদের স্পেশালী ট্রিট করি কিন্তু স্কুলের তো কিছু রুলস আছে।
হা ফাদার, আমি তা বুঝি।
আপনি প্লীজ ওদের বলবেন রেগুলারলি স্কুলে যেতে।
নিশ্চয়ই বলব।
থ্যাঙ্ক ইউ রাজাবাবু।
ওরা স্বামী-স্ত্রী বার বার বলেও কোন ফল হয় না। ছেলেমেয়েরা দুদিন স্কুলে গেলে তিনদিন যায় না। ভাগ্যক্রমে স্কুলে গেলেও মাথা ধরা, পেট কামড়ানোর অজুহাতে অনেকেই অনেক দিন পুরোস্কুল করবে না। গৃহ-শিক্ষকরাও সকাল-সন্ধেয় নিয়মিত আসাযাওয়া করেন, চা-জল খাবার খান কিন্তু তারা অধিকাংশ দিনই ছাত্র-ছাত্রীদের দর্শন পান না।
এইভাবেই বছরের পর বছর কেটেছে। অবলাকান্ত গোপনে গোপনে পাদ্রীদের স্কুলে প্রতি বছর কিছু দানধ্যান করে ছেলেমেয়েদের প্রমোসন ব্যবস্থা করেছেন। কী করবেন? সব ছেলেমেয়ে ফেল করলে ওর সম্মান থাকে কোথায়?
মোহনবাগানের শীল্ড জয়ের খবর ছড়িয়ে পড়তেই বড় ছেলে সূর্যকান্ত অবলাকান্তকে বলল, বাবা, বাঙালীদেব ক্লাব মোহনবাগান সাহেবদের হারিয়ে শীল্ড জয় করেছে, সে খবর জানেন?
শুনেছিলাম বটে।
আমি কলকাতা যাব।
তার সঙ্গে মোহনবাগানের শীল্ড জয়ের কী সম্পর্ক?
ঠিক করেছি আমিও মোহনবাগানে খেলে সাহেবদের হারাব।
জ্যেষ্ঠপুত্রের কথাবার্তার ধরন দেখেই ওঁর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বলেন, সাহেবদের হারানো কী খুব মহৎ কাজ? নাকি জমিদারবাড়ির ছেলে হয়ে সাহেবদের বিরুদ্ধে খেলা খুব সম্মানজনক?
মিনিটখানেক চুপ করে থাকার পর সূর্যকান্ত বলে, কিন্তু আমি ফাইনালি ঠিক করেছি মোহনবাগানে খেলব।
অবলাকান্ত পুত্রের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে কী সেই খেলা দেখার নেমন্তন্ন করছ? নাকি আমাকেও খেলতে হবে?
না মানে…
কী বলতে চাও, চটপট বল। আমার অনেক কাজ আছে।
আমাকে টাকা দিতে হবে।
কেন?
টাকা না দিলে ওরা আমাকে খেলতে দেবে কেন?
অবলাকান্ত ভুরু কুঞ্চিত করে বড় কুমারকে জিজ্ঞেস করেন, ফুটবল গোল না চৌকো, তা তুমি জানো?