এবারও উকিলবাবু চুপ। কী বলবেন?
শুধু যতীন মুখুজ্যের বাড়িতেই না বাঙালীটোলার ঘরে ঘরেই অবলাকান্তকে নিয়ে আলোচনা শুরু হল। সবাই স্বীকার করলেন, লোকটা সত্যি রাজা। রাজা না হলে ঐ রকম প্রাসাদ বানাতে পারে? নাকি অমন মুড়ি-মুড়কির মত টাকা খরচ করতে পারে? সেদিন দুপুরে অবনী চাটুজ্যেদের বাড়ির পাঁচ বউ শুয়ে শুয়ে অবলাকান্তকে নিয়েই আলোচনা করছিলেন। বাড়ির বড় বউ অবনী-গিন্নী বললেন, অবলাকান্তর স্ত্রীকে দেখতে সত্যি রানীর মত। এই বয়সেও কী রূপ! চোখ ঝলসে যায়?
সেজ বউ বললেন, তাছাড়া বড়দি, উনি কত হীরের গহনা পরে ছিলেন, তা দেখেছো?
মেজ বউ একটু হেসে বললেন, আজ ওকে দেখে যতীন উকিলের বউয়ের দেমাক ঠাণ্ডা হয়েছে।
বড় বউ বললেন, আমি খুব খুশি। যতীন উকিলের বউয়ের এত অহঙ্কার আর সহ্য করা যাচ্ছিল না।
ছোট বউ বললেন, বড়দি, শুধু ওর কথা কেন বলছ? ডাক্তার বাবুর স্ত্রীর অহঙ্কার কী কম?
আবার একটা পান মুখে পুরে মেজ বউ বললেন, এবার সব ঠাণ্ডা। নন্দ ঠাকুরপোর ছেলের অন্নপ্রাশনে আমি গরদ পরে যাইনি বলে ডাক্তারের বউ আমাকে সবার সামনে যে অপমান করেছিল, তা কী আমি জীবনে ভুলব?
বড় বউ বললেন, ঐ উকিল আর ডাক্তারের বউ–দুটোই সমান। সব সময় দেখাতে চায় ওদের অনেক টাকা আছে। আর এখন? অবলা বাড়ুজ্যে তো ওদের মত লোককে চাকর রাখতে পারে। দুতিন বউ একসঙ্গে বলে, ঠিক বলেছ!
শুধু মেয়েদের মধ্যে না, বাঙালীটোলার পুরুষদের মধ্যেও এখন। একমাত্র আলোচনার বিষয় রাজা অবলাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। বৈঠক খানায়, তাসের আড্ডায়, ব্যায়ম সমিতির মাঠে, কালীমন্দিরের চত্বরে–যেখানেই দু-চারজন বাঙালী বাবুদের দেখা হয়, সেখানেই ঐ একথা, আলোচনা। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ কিন্তু মাস ঘুরতে ঘুরতেই বাঙালীদের আলোচনায় নতুন মোড় ঘুরল।
সেদিন কী কারণে যেন কোর্ট-কাছারির ছুটি। স্কুল-টুলও বন্ধ। কর্তা ব্যক্তিরা সবাই বাড়িতে আছেন বা ইতিমধ্যে পাড়ার সমস্ত বাচ্চা কাচ্চার সম্মিলিত চিৎকার–মোটরগাড়ি! মোটরগাড়ি!
মোটরগাড়ি? বাঙালীটোলায়? ছেলেমেয়েরা বলে কী? এ শহরে শুধু কালেক্টর সাহেবের মোটরগাড়ি আছে। তাও তিনি নিয়মিত ব্যবহার করেন না। কদাচিৎ, কখনও। তবে ছোটলাট মাঝে মাঝে আসেন বলে কালেক্টর সাহেবকে এই মোটরগাড়ি দেওয়া হয়েছে। ছেলেমেয়েদের চিৎকার শুনে বুড়ো-বুড়ীরাও চুপ করে বসে থাকতে পারেন না। বাইরে বেরিয়ে না এলেও ওরা সবাই জানলা দিয়ে উঁকি দিলেন। না দিয়ে পারলেন না। হ্যাঁ সত্যি তো একটা মোটরগাড়ি ঐ মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। তবে কী কালেক্টর সাহেব এলেন? কিন্তু বাঙালীটোলায়…
দাদু! দাদু! রাজবাড়ির মোটরগাড়ি।
কী বললি?
রাজবাড়ি থেকে মোটরগাড়ি এসেছে তুই কী করে জানলি?
আমি শুনলাম।
প্রথমে বুড়ো-বুড়ীরা বিশ্বাস করেননি কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেখা গেল, ওরা ঠিকই বলেছে। আগামী শনিবার সন্ধ্যায় রাজ বাড়িতে শনি-সত্যনারায়ণ পূজা হবে। তাই স্বয়ং অবলাকান্তর স্ত্রী বাড়ি বাড়ি নেমন্তন্ন করতে বেরিয়েছেন।
গড়গড়ার নল পাশে সরিয়ে রেখে যতীন মুখুজ্যে ওর স্ত্রীকে বললেন, বুঝলে গিন্নী, অবলাকান্ত এক ঢিলে দুই পাখি মারল। শনি-সত্য নারায়ণের নেমন্তন্ন করাও হল, আবার নতুন মোটরগাড়িটাও বাঙালীটোলার সবাইকে দেখিয়ে গেলেন।
তা ঠিক কিন্তু মোটরগাড়িটা ভারী সুন্দর!
উকিলবাবু চুপ।
তাছাড়া যে লোকটা গোল চাকার মত কি একটা ধরে চালাচ্ছিল, সে কী সুন্দর জামা-কাপড় পরেছিল!
এবারও উকিলবাবু চুপ।
গিন্নী কিন্তু চুপ করে থাকতে পারেন না। স্বামীকে জিজ্ঞেস করেন, হ্যাঁগো-একটা মোটরগাড়ি কিনতে কত টাকা লাগে?
হবে দশ-পনের হাজার।
বাপরে বাপ! এত টাকা লাগে? ঐ টাকা দিয়ে তো তুমি দু-তিনটে বাড়ি বানিয়েছ?
এবার উকিলবাবু একটু রেগেই বলেন, আজেবাজে বকবক করা বন্ধ কর তো।
যাইহোক এই ভাবেই অবলাকান্ত তার পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যাকে নিয়ে এই নতুন শহরে জীবন আরম্ভ করলেন।
৫. মানুষ সুখে-দুঃখে যে ভাবেই থাক
মানুষ সুখে-দুঃখে যে ভাবেই থাক, সময় কখনও দাঁড়িয়ে থাকে না। মানুষ অলস কর্মহীন থাকলেও ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে প্রায় অলক্ষ্যেই এগিয়ে চলে। পচা ভাদ্দরের মেঘে সারা আকাশ ছেয়ে থাকলেও সূর্য ঠিক সময়েই উদয় হয়, অস্ত যায়। শত সহয় মানুষের তর্জন-গর্জন বা চোখের জলে ফুল ফোঁটা মুহূর্তের জন্যও বিলম্বিত হয় না। সর্বত্যাগী উদার সন্ন্যাসীর মত সময় ও প্রকৃতি তাদের আপন সাধনায়, লীলাখেলায় মত্ত।
হঠাৎ একদিন অবলাকান্তের খেয়াল হল, প্রয়াগ ত্যাগ করে আসার পর এই শহরে অনেকগুলি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। মন-মেজাজ ইদানীং ভাল যাচ্ছে না। সব সময় ঐ এক চিন্তা, যে খবর পর স্ত্রী বা ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত জানতে পারেনি এবং ড্রাইভার বা দারোয়ান চাকর-বাকরদের পক্ষেও জানা অসম্ভব, সে খবর বাঙালীটোলায় ছড়িয়ে গেল কী করে? সর্বোপরি এ খবর কালেক্টর সাহেবের কাছে কে বা কারা পৌঁছে দিলেন?
কালেক্টর সাহেব অনুরোধ করলে উনি হাসতে হাসতে স্কুলের জন্য দশ হাজার কেন, বিশ হাজারও দিতে পারতেন কিন্তু এই কেলেঙ্কারী চাপা দেবার জন্য টাকা দিয়েছেন বলেই অবলাকান্তের দুঃখ। মনে বেদনা।