এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরব দেশে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গেল। পাকিস্তান ও পাক এম্বাসী কি ফাপরেই না পড়েছিল।
কায়রোয় ভারত-পাক এম্বাসীর মধ্যে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক মেঘ জমে উঠেছে, কখনও গর্জন-কখনও বর্ষণ হয়েছে, তখনও বেসুরো সুরে হাসান আর তরুণ গেয়েছে–
আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি!
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস,
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশী।
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে
ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় হায় রে–
ও মা অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে
আমি কী দেখেছি মধুর হাসি…
রাবেয়া পাশের ঘর থেকে প্রায় তেড়ে এসে বলেছে, এমন গর্দভ রাগিণীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত হয় না…চল চল, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। সিনেমায় যাবে না?
আড্ডা দিতে দিতে হাসান আর তরুণের খেয়ালই ছিল না কায়রো প্যালেসের টিকিট কাটা আছে।
তিনজনে দল বেঁধে সিনেমায় গেছে, ওমর খৈয়ামে ডিনার খেয়েছে ও অনেক রাতে তিনজনে বাড়ি ফেরার পথেও অল-তারির স্কোয়ারে বসে গল্প করেছে।
ভোলা যায় কি সেসব স্মৃতি? তরুণ ভুলতে পারে না কায়রোকে। ভুলবে কেমন করে? কারমান্নেসা স্কুলের ছাত্রীকে দেখেই তো মনের মধ্যে অতীত দিনের ঝড় উঠেছিল। ইন্দ্রাণীর স্মৃতির আগুনে ঘৃতাহুতি পড়েছিল এই কায়রোতেই।
০৪. ভাইকাউন্টের চারটে ইঞ্জিন
ভাইকাউন্টের চারটে ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল। পাখাগুলো বন-বন করে ঘুরতে শুরু করল। তারপর কোনো ফাঁকে প্লেনটা পালামের মাটি ছেড়ে উড়তে শুরু করল। কাবুলের ইন্ডিয়ান এম্বাসীর সেকেন্ড সেক্রেটারি-ডেজিগনেট তরুণ সেনগুপ্তর মনটাও হঠাৎ উড়তে শুরু করল অতীত আকাশের কোলে।…
সেই কোনো সুদূর অতীতে আর্যরা এই পথ দিয়েই এসেছিলেন ভারতবর্ষে। কোথা থেকে এসেছিলেন, কে জানে। কেউ বলেন, পামির থেকে, কেউ বলেন, মধ্য ইউরোপ বা জার্মানী থেকে। মানব সভ্যতার প্রায় আদিমতম সুপ্রভাত আর্যরা আফগানিস্থানে বসেই লিখেছিলেন বেদঋগ্বেদ। কলকাতার রাস্তায় ওই পাগড়ী পরা কাবুলীওয়ালাদের দেখে বিশ্বাস করা কঠিন যে, এঁদের ঘরের দাওয়ায় বসে আমাদের আর ওঁদের পূর্বপুরুষ লিখেছিলেন বেদ। ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে আর্যদের কথা, আমাদের পূর্বপুরুষদের কাহিনি। সভ্য আর্যদের বংশধর বলে গর্ব অনুভব করি আমরা কিন্তু বাইরের জগতে আর্য বলে প্রচার করতে কত কুণ্ঠা আমাদের। আর ওই কাবুলীরা? মুসলমান আফগানরা? সারা দুনিয়ার সামনে বুক ফুলিয়ে বলেন ওরা আর্য। ওদের যেসব বিমান সারা বিশ্বে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার পরিচয়পত্রে বড় বড় হরফে লেখা আছে আরিয়ানা আফগান এয়ারলাইন্স। কাবুলের সব চাইতে প্রাচীন সরকারি হোটেলের নাম, হোটেল আরিয়ানা।….
ভাইকাউন্টের ডিম্বাকৃতি বড় জানলা দিয়ে তরুণ আর একবার নিচের দিকে তাকায়। কত গিরি-পর্বত নদী-নালা মাঠ-ঘাট পেরিয়ে এই পথ দিয়েই এসেছেন ইতিহাসের কত অসংখ্য নায়ক। আলেকজান্ডার, ইবন বতুতা, মহম্মদ ঘোরী, তৈমুর, বাবর ও আরো কত কে। এসেছিলেন কনিষ্ক, এসেছিলেন চীনা পরিব্রাজকের দল। মার্কোপোলো পর্যন্ত লিখে গেছেন এই পথের কথা। হিমালয়ের এই অলিগলি ডিঙিয়েই আফগানিস্থান থেকে ভগবান বুদ্ধের বাণী ছড়িয়েছিল চীনে, জাপানে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরো কত দেশে।
উল্টো-পাল্টা, ছোট-বড়, সাদা-কালো মেঘের মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছে ভাইকাউন্টটা। তরুণের চিন্তার ধারাটাও ওলট-পালট হয়ে যায় মাঝে মাঝে। তাতে কি আসে যায়? তাতে কি ইতিহাসের গুরুত্ব কমে? নাকি কম রোমাঞ্চ লাগে? ইরাণের বিখ্যাত কবি তো বলে গেছেন, মা যি আঘাষ যি আনজাম-ই জাহান বে-খবর-ইম, আওয়াল-ও-আখের ই-ই কুহনা কেতাব উতাদ আস্ত। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ইতিকথার প্রথম ও শেষ পাতাটাই খোয়া গেছে, তাই তো আদি-অন্তের হিসেব-নিকেশ পাওয়াই দুষ্কর। ভাইকাউন্টের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে উল্টো-পাল্টা চিন্তা করতে করতে সান্ত্বনা পায় তরুণ।
মিঃ যোগীকে টোকিও থেকে কাবুলে বদলি করা হয়েছিল। বদলির অর্ডার পাবার পর প্রায় মূৰ্ছা যাবার উপক্রম। টোকিও থেকে কাবুল! বোয়িং সেভেন-জিরো-সেভেন চড়ার পর সাইকেল রিকশা। কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে যোগীসাহেব আপীল করলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে, স্ত্রীর স্বাস্থ্য, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া গোল্লায় যাবে। দোহাই আপনাদের।
শুধু যোগীসাহেব নয়, ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসের অনেকেরই এই মনোভাব। লন্ডন, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, প্যারিস, রোম বা টোকিও ছাড়া সারা দুনিয়াটা যেন মনুষ্য-বাসের অনুপযুক্ত। মস্কো বা ইউরোপের অন্য কোনো রাজধানীতে খুব জোর দু-তিন বছরের একটা টার্ম চললেও চলতে পারে, কিন্তু তাই বলে এশিয়া আফ্রিকায়? কল্পনা করতে পারেন না এঁরা। কিছু কিছু ইন্ডিয়ান আছেন যাঁরা অতীত দিনের প্রভুদের সমাজে মর্যাদা পাবার লোভে অথবা যৌবনের কোনো দুর্বল মুহূর্তে শ্বেতাঙ্গিনীকে জীবন-সঙ্গিনীরূপে গ্রহণ করেছেন। এখন এসব মেমসাহেবের দল মাইশোর সিল্কের শাড়ি পরেন, ইন্ডিপেনডেন্স ডে রিসেপশনের সময় স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে নমসটে করেন সত্য, কিন্তু ইন্ডিয়াতে থাকার কথা ভাবতেও ওদের গাটা শিউরে ওঠে। কি বিশ্রী ফ্লাইজ! মসকুইটো! বেগার! নেকেড সাধুস!