বিধুবাবু সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ব্যাঙ্কের কাজে যাচ্ছ বললেই ব্যাঙ্ক সব খরচ-পত্তর দিতে বাধ্য।
পারুল দেবী স্বামীর পাশে বসেই বললেন, তাহলে আমার একটা প্রস্তাব তোমাদের সাবাইকে মেনে নিতে হবে।
শ্যামাপদ সঙ্গে সঙ্গে একটু হেসে বলেন, বৌদি, আপনার প্রস্তাব না মেনে নিলে ভবিষ্যতে আমাদের প্রস্তাবও তো আপনি মেনে নেবেন না।
না, তা না কিন্তু…
বিধুবাবু বললেন, আগে তোমার প্রস্তাবটাই তো বলো।
পারুল দেবী গম্ভীর হয়ে বললেন, কালই ন’ঠাকুরপোকে বাইরে যাবার জন্য দশ হাজার টাকা দেবার ব্যবস্থা করবে।
শিবপদ অবাক হয়ে বলেন, আমি ব্যাঙ্কের কাজে দিল্লি-বোম্বে গিয়ে কী করব?
বিধুবাবু বলেন, ওরে বাপু, শুধু ব্যাঙ্কের খাতায় লেখা থাকবে তুমি ব্যাঙ্কের কাজে যাচ্ছ।
পারুল দেবী বলেন, ন’ঠাকুরপো ওর স্ত্রী আর ছেলেদের নিয়ে ঘুরে আসার পর সেজ ঠাকুরপোরা বাইরে যাবেন। তারপর আমরা যাবো।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, কী, আমার প্রস্তাব পাস হলো তো?
ওরা তিনজনেই এক সঙ্গে হাসতে হাসতে বললেন, পাস।
.
অঘোরনাথ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ছোট মা, মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে বাঘ যেমন পাগল হয়ে ওঠে, সেইরকম পরের টাকায় ফুর্তি করার সুযোগ পেলেও মানুষ আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না।
উনি একটু থেমে বলেন, ঐ হতচ্ছাড়া বিধু দত্তর পাল্লায় পড়ে সেজবাবুনবাবু পর্যন্ত দুহাতে না–দশ হাতে ব্যাঙ্কের টাকা ওড়াতে শুরু করলেন।
কণিকা জিজ্ঞেস করেন, কী ভাবে ওরা টাকা ওড়াতে শুরু করলেন? ব্যাঙ্কের টাকা কী যা-তা ভাবে খরচ করা যায়?
অঘোরনাথ একটু হেসে বলেন, ছোট মা, তখনকার দিনে পান-বিড়ি বা মুদিখানার দোকান খোলার মত যে কেউ ব্যাঙ্কের ব্যবসা করতে পারত। তবে টাটা-বিড়লাদের মত পাকা ব্যবসাদাররা অন্য পাঁচটা ব্যবসার মত ব্যাঙ্কের ব্যবসাও ভাল ভাবে চালিয়ে লাখ লাখ কোটি-কোটি টাকা লাভ করত। আর বিধু দত্তদের মত বেইমানরা শুধু জোচ্চুরি করার জন্যই ব্যাঙ্ক খুলেছিল।
উনি একটু থেমে বলেন, দেশ স্বাধীন হবার পর ব্যাঙ্কের এইসব জোচ্চুরি বন্ধ করার জন্যই নতুন আইন তৈরি হয়।
যাই হোক বিধু দত্তদের কথা বলুন।
বছর দুয়েকের মধ্যে ওদের ঐ ব্যাঙ্ক দার্জিলিং কুচবিহার-রাজশাহি থেকে চব্বিশ পরগনা-মেদিনীপুর আর চট্টগ্রাম-নোয়াখালি থেকে বর্ধমান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। আর তার ফলে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ তাদের দুশ পাঁচশ বা হাজার দু হাজার টাকা এই ব্যাঙ্কে রাখায় বিধু দত্তদের হাতে কোটি কোটি টাকা এসে গেল।
অতগুলো ব্রাঞ্চ খুললে কোটি কোটি টাকা তো জমা পড়বেই।
অঘোরনাথ একটু হেসে বলেন, বিধু দত্ত প্রথমেই কী করলেন জানো?
কী?
শেয়ারহোল্ডার ডিরেক্টরদের প্রায় সব টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নিলেন। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল লুটপাট।
লুটপাট মানে?
হাজার রকম ভাবে ওরা ব্যাঙ্কের টাকা ওড়াতে শুরু করলেন।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, বিধু দত্ত সেজবাবুনবাবুকে খুশি করার জন্য প্রথমেই ওদের দুই ছেলেকেও ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার করে দিলেন।
তখন সেজবাবুনবাবুর ছেলেরা কত বড় ছিল?
তখন ওদের বয়স সাতাশ-আঠাশ হবে।
ও! তার মানে বেশ বড়?
হ্যাঁ।
অঘোরনাথ একটু হেসে বলেন, ওরা দুজনে ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার হবার পর ওদের হাব-ভাব চাল-চলন দেখে সারা পাড়ার লোক কী হাসাহাসি করত।
কেন?
উনি চাপা হাসি হেসেই বলেন, দত্তদের উপর মা লক্ষ্মীর অপার করুণা থাকলেও সরস্বতীর সঙ্গে ওদের কারুরই বিশেষ ভাল সম্পর্ক ছিল না। ওদের বাড়ি ছেলেরা চিরাচরিত নিয়মে পারিবারিক ব্যবসা চালাতে জানলেও ব্যাঙ্কের কেরানি হবারও যোগ্যতা ঐ দুই ছেলের ছিল না।
তাহলে ওরা কাজ করতেন কী করে?
বিধুবাবুর নির্দেশ মত স্নেহময় সরকার সব কাগজপত্র তৈরি করিয়ে শুধু ওদের দিয়ে সই করিয়ে নিতেন।
অঘোরনাথ হঠাৎ একটু উত্তেজিত হয়ে বলেন, বিধু দত্ত ডজন ডজন আজেবাজে লোকের নামে আজগুবি সম্পত্তির মিথ্যা দলিল তৈরি করে ব্যাঙ্কে সেগুলো বন্ধক রেখে প্রায় চল্লিশ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে।
বলেন কী?
হ্যাঁ, ছোট মা, ঠিকই বলছি।
উনি একটু থেমে একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, পরবর্তীকালে গভর্নমেন্টের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে জানা যায় যে সেজবাবুনবাবুর দুই মুখ ছেলে ঐটাকা মঞ্জুর করেছিল।
সেজবাবু-নবাবুও ব্যাঙ্কের টাকা মেরেছিলেন?
না, না, ওরা চুরি-জোচ্চুরি করে টাকা মারেনি; তবে….
অঘোরনাথ কথা শেষ না করে থামতেই কণিকা জিজ্ঞেস করেন, তবে কী?
পরিচিত-অপরিচিত যারাই ওদের ধরাধরি করেছে, তাদেরই ওরা ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার দিয়েছে। তাদের কেউই ব্যাঙ্কের টাকা শোধ দেয়নি।
এইভাবে যা তা ভাবে টাকা নেয়ার পর ব্যাঙ্ক চলত কী ভাবে?
ব্যাঙ্ক তো চলেনি।
চলেনি মানে?
হঠাৎ একদিন লোকজন নিজেদের গচ্ছিত টাকা তুলতে এসে দেখল, ব্যাঙ্ক টাকা দিতে পারছে না।
বলেন কী ছোটকাকা? ব্যাঙ্ক টাকা দিতে পারলো না?
না, না, দিতে পারলো না।
অঘোরনাথ একটু থেমে বলেন, ওদের ঐ ব্যাঙ্কের হেড অফিস ছিল আমাদের এই ভবানীপুরেই, আর সেখানেই থাকতে খদ্দেরদের বন্ধক দেওয়া সোনা-দানা ছাড়াও ব্যাঙ্কের বারো আনা টাকা। খদ্দেরদের টাকা দেওয়া যাবে না বুঝতে পেরেই বিধু দত্ত আর স্নেহময় সরকার একদিন মাঝরাত্তিরে হেড অফিসের আলমারি সিন্দুক থেকে সমস্ত সোনাদানা-টাকাকড়ি নিয়ে উধাও হয়ে যায়।