এবার মল্লিকমশাই হেসে বলে, আপনি রোজ দশ-বিশ লরি মাল সাপ্লাই দেন আর আমি হয়তো মাসে দুএক লরি মেসিনপত্তর রেল কোম্পানিতে বিক্রি করি। হরে-দরে একই ব্যাপার।
বড়কর্তা এক গাল হাসি হেসে বলে, না, না, তাই কি হয়?
গদির পুরনো দারোয়ান গড়গড়াটা বড়কর্তার হাতের কাছে দিতেই উনি বললেন, আমার এইসব নেশাটেশা নেই হে।
নরোত্তম মল্লিক সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ওরে রামলাল, ভবানীপুরের বড়লোকেরা কি এইসব সস্তার নেশা করেন? ওটা নিয়ে যা।
বড়কর্তা আবার হেসেই বলেন, সত্যি আমার কোনো নেশাটেশা নেই।
রামলাল গড়গড়াটা নিয়ে যেতেই মল্লিমশাই একটু ঝুঁকে ফিস ফিস করে বলে, নেশাটেশা তো নেই বললেন, কিন্তু মনটাকে এত সতেজ রেখেছেন কী করে?
বড়কর্তা হো হো করে ওঠেন। বলেন, মনে হচ্ছে, আপনিও বেশ রসিক ব্যক্তি।
–সবই আপনাদের আশীর্বাদ!
বড়কর্তা এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটু চাপা গলায় বলেন, আজ সন্ধের পর আমার সঙ্গে চলুন। দুজনে মিলে একটু আমোদ-আহাদও হবে, আবার কথাবার্তাও বলা যাবে।
মলিকমশাই চাপা হাসি হেসে জবাব দেয়, আপনি হুকুম করলে কি আমি না শুনে থাকতে পারি?
দুজনেরই সে কি হাসি!
.
সমবয়সী না হয়েও সেদিন থেকে ওঁরা বন্ধু হয়ে গেলেন। নিত্যনৈমিত্তিক না হলেও প্রায়ই ওঁদের দেখাশুনা হয়। ব্যবসা বাণিজ্য ঘর-সংসার থেকে শুরু করে এমনকি সাবিত্রীসুহাসিনীকে নিয়েও ওঁদের কথাবার্তা হয়।
–আরে এসো, এসো নরোত্তম, তোমার কথাই ভাবছিলাম। হাতের ফাইলটা পাশে রাখতে রাখতে বড়কর্তা ওকে অভ্যর্থনা জানান।
তুমি খুব ব্যস্ত না তো?
কাজ তো সারাদিনই আছে কিন্তু সব সময় কি কাজ করতে ভাল লাগে? নরনারায়ণ সরকার এক মুহূর্তের জন্য একটু থেমেই বলেন, তুমি আজ না এলে কাল সকলেই আমি তোমার কাছে যেতাম।
-কেন? কোনো কাজ আছে?
বড়কর্তা এবার কোনো ভূমিকা না করেই বলেন, নরোত্তম, তোমার জন্য একটা জমি দেখেছি।
কোথায়?
–আমাদের ভবানীপুরেই।
–ওখানে জমি নিয়ে আমি কী করব?
–কী আবার করবে? একটা বাড়ি বানাবে।
–বাড়ি তো আমার আছেই।
–সেকি আমি জানি না? কিন্তু ভবানীপুরে কীভাবে জমির দাম বাড়ছে, তার খবর রাখে?
নরোত্তম সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে বড়কর্তার দিকে তাকায়। বড়কর্তা একটু হেসে বলেন, যে জমি আগে পাঁচশ টাকায় বিক্রি হতো না, সেইসব জমি এখন তিন থেকে পাঁচ হাজারে পাওয়া কঠিন।
–সারা কলকাতাতেই জমির দাম বাড়ছে। নরোত্তম একটু হেসে বলে, কী বলব বড়কর্তা, বাগবাজারের খালের উত্তরেও এখন দোতলা-তিনতলা বাড়ি হয়ে গেছে। আমি তো ওখানে থাকার কথা ভাবলে শিউরে উঠি।
–আরে আমাদের ওদিকে কালীঘাট পর্যন্ত খালি জমি বিশেষ চোখে পড়ে না। তাই বলছিলাম, সস্তায় যখন জমিটা পাওয়া যাচ্ছে, তখন তুমি নিয়েই নাও।
জমিজমা কিনতো আমার আপত্তি নেই কিন্তু জমিজমায় টাকা আটকে রাখলে আমাদের মতো ব্যবসাদারদের অসুবিধেয় পড়তে হতে পারে।
–তেমন অসুবিধে হলে আমাকে বলো। কিন্তু পঞ্চাশ হাজারে দেড় বিঘে জমি হাতছাড়া করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বড়কর্তা একটু থেমে বলেন, ভদ্রলোক পুরো
জমিটা একসঙ্গে একজনকে বিক্রি করবেন বলেই এত সস্তায় দিচ্ছেন।
নরোত্তম একটু ভেবে বলে, ঠিক আছে, তুমি যখন বলছে, তখন ঐ জমিতে একটা বাড়ি বানিয়েই ফেলব। ছোট বউএর ছেলেপুলে হলে…
বড়কর্তা এক গাল হাসি হেসে বলেন, এই তো বুদ্ধিমানের মতো কথা!
.
কলকাতার চীনাবাজার ক্যানিং স্ট্রিট তখন এইসব দত্ত-সরকার-মল্লিক-দে আর কিছু বোস-ঘোষ-মিত্তিরদের একচেটিয়া। ক্লাইভ স্ট্রিটের অর্ধেক সাহেবদের দখলে থাকলেও বাকি অর্ধক এদেরই দখলে। গঙ্গার ধারে পর পর সাহা আর কুণ্ডুদের গুদাম। বড়বাজারের অসংখ্য দোকানদাররাও এইসব সাহা-কুণ্ডু বা দত্ত-সরকার-মল্লিকদের কোনো না কোনো দূরসম্পর্কের আত্মীয়। এছাড়া সারা কলকাতা শহরের সব বাজারের বারো আনা দোকানদারও বাঙালি। ধর্মতলা-চৌরঙ্গির চোদ্দ আনা ব্যবসাই তখন বাঙালি আর পশ্চিমী মুসলমানদের দখলে।
দিল্লির দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদ আর মোহনবাগানের আই-এফ-এ শিল্ড জেতার পর বাঙালির ঘরে ঘরে উৎসব আর আলোচনা।
-ওরে বাপু, সারা দেশ কি এমনি বাঙালিদের খাতির করে? না করে উপায় নেই। হাইকোর্টের জজ কে? বাঙালি। বিখ্যাত অধ্যাপক কারা? বাঙালিরা। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কারা? বাঙালি। বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা কারা? তিলক-গোখলে-লাজপত রায়কে বাদ দিলে আর সব নেতাই তো বাঙালি। ডাক্তার-এঞ্জিনিয়ার-উকিল-মোক্তার থেকে সব বড় বড় সরকারি অফিসারও তত বাঙালি।
পাশের ভদ্রলোক নাকে নস্যি দিয়েই বলে, এককথায় বলে দাও, ছোট দারোগাবাবু আর শ্যালদা স্টেশনের টিকিটবাবু থেকে শুরু করে ভাইসরয় কাউন্সিলের মেম্বার পর্যন্ত সবই বাঙালি।
–ঠিক বলেছে মশাই।
এবার আই-এফ-এ শিল্ড জিতেও আমরা দেখিয়ে দিলাম, ফুটবল খেলাতে বাঙালি বেস্ট!
–একশ বার আমরা বেস্ট!
পারুল রেস্টুরেন্টে আজ্ঞা যখন পুরোদমে জমে উঠেছে, ঠিক সেই সময় পরিপাটি সেজেগুঁজে ইম্পিরিয়্যাল ব্যাঙ্কের গোপাল মুখুজ্যে ঢুকতেই সবাই হই হই করে উঠলেন। হই হই করে ওঠার অবশ্য কারণ ছিল।
গোপালবাবুর বাড়ি হাওড়ার কালীবাবুর বাজারে পিছনে। ওখানেই ওঁর সংসার। চাকরি করেন ভবানীপুরের ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কে। তবে এই ব্যাঙ্কের মাইনে দিয়ে ওঁর সংসার চালাতে হয় না। কবিরাজ দাদুর মকরধ্বজ চ্যবনপ্রাশের কৃপায় সংসার ভালভাবেই চলে। এছাড়া দুটো বতির আয় আছে। সুতরাং দাদুর স্নেহধন্য গোপাল ভবানীপুরের ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কের টাকাটা এই ভবানীপুরের পারুল রেস্টুরেন্টেই দিয়ে যান। বন্ধুবান্ধব ইয়ার-দোস্তরা ওঁকে ভালবাসবেন না কেন?