সরি! সেদিন আমার কাছে সাড়ে বারোশ রাউন্ড গুলির একটাও অবশিষ্ট ছিল না। যদি থাকত, নিশ্চয়ই সদ্ব্যবহার করতাম।
জেনারেল ডায়ার দুঃখ করে আরো বলেছিলেন, গলিটা বড় সরু ছিল বলে মেসিনগান দুটো ভিতরে নেওয়া যায়নি। ও দুটো ভিতরে নিতে পারলে বড় খুশি হতাম!
এরাই হচ্ছে স্যার জন অ্যান্ডারসনের পথিকৃত। মনে মনে বোধহয় ইনিও স্বপ্ন দেখতেন বিলেতের কাগজে বীরপুরুষ জেনারেল ডায়ারের মতো তারও ছবি ছাপা হয়েছে। জালিয়ানওয়ালাবাগ কীর্তির মহানায়ক এই জেনারেলকে বিলেতের লোক কৃতজ্ঞতাস্বরূপ পঁচিশ-ছাব্বিশ হাজার পাউন্ডের এক তহবিল পুরস্কার দিয়েছিল। অ্যান্ডারসন বোধহয় দেশবাসীর কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের তহবিল আশা করেছিলেন।
জানেন ক্যাপ্টেন সাহেব, লাটসাব একদম উন্মাদ হয়েছিলেন। তাছাড়া মেদিনীপুরে হরদম আংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটকে মেরে ফেলার জন্য কলকাতার আংরেজরাও বড় ক্ষেপে উঠেছিল।
এমন গুরুত্বপূর্ণ কাহিনি বলতে বলতেও বুড়ো রমজান ফিক করে একটু হাসে। বলে, একদিন ওই পিছনের বাগানে বেড়াবার সময় লাটসাব মেমসাবকে একটা গাছের ছায়া দেখিয়ে বললেন, হায়াটা ঠিক মেদিনীপুরের ম্যাপের মতো!
সব সময় ওই এক চিন্তা! মেদিনীপুর।
সাহেবের অফিস কামারায় সামনে ছিল ওই মেদিনীপুরের ম্যাপ আর পিছনে থাকত বাংলাদেশের ম্যাপ।
ইংরেজ অনেক চিন্তা-ভাবনা করে এই স্যার জন অ্যান্ডারসনকে পাঠিয়েছিল বাংলাদেশে। বোধহয় পঞ্চ নদীর পুণ্যতীর্থ জালিয়ানওয়ালাবাগের পুনরাবৃত্তি চেয়েছিলেন বাংলাদেশে। কর্ণফুলি, বুড়িগঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা, ভাগীরথীর বাংলাদেশে!
ডালহৌসীর গভর্নমেন্ট হাউসের এই নব নায়ক আগে ছিলেন ইমন ডি ভ্যালেরার আয়ারল্যান্ডে। সিন-ফিন মুভমেন্টের জন্য ইংরেজ শাসকদের অনেক বিনিদ্র রজনী যাপন করতে হচ্ছিল। তাই তারা পাঠিয়েছিলেন স্যার জনকে।
জার্মানদের সহযোগিতায় স্বাধীনতাকামী আইরশিরা শুরু করেছিলেন সিন-ফিন আন্দোলন। এদের শায়েস্তা করার জন্য অ্যান্ডারসন সৃষ্টি করেছিলেন কুখ্যাত ব্ল্যাক এন্ড ট্যান ইংরেজ পুলিশ বাহিনী! ওদের অত্যাচারের কাহিনি শুনলে গা শিউরে উঠবে।
অ্যান্ডারসন সাহেব বাংলাদেশে এসে গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো করতে চেয়েছিলেন। বাঙালি দিয়ে বাঙালিকে শায়েস্তা করার জন্য জন্ম নিল ভিলেজ গার্ড!
দিন রাত্তির চব্বিশ ঘণ্টা ওই এক চিন্তায় মেতে থাকতেন অ্যান্ডারসন। মেদিনীপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম! নিজেদের মেয়েদের চাইতে প্রিয় ছিল আর্মি আর পুলিশ অফিসাররা। ওরাই ছিল স্যার জনের প্রিয় সহচর। বন্ধু, আত্মীয়, পরমাত্মীয়!
এখনকার মতো তখন এই গভর্নমেন্ট হাউসের শুধু নর্থ গেটেই পুলিশ প্রহরী থাকত না। নর্থ, সাউথ, ইস্ট, ওয়েস্ট-সব গেটেই থাকত পুলিশ। সশস্ত পুলিশ। আরো পার্থক্য ছিল। এখন হিজ একসেলেন্সির দ্বাররক্ষক হচ্ছেন একজন সাব-ইন্সপেক্টর ও জনা কয়েক কনস্টেবল। হিজ একসেলেন্টসি ইজ্জত বাঁচাবার জন্য মাঝে দেখা যাবে একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সার্জেন্টকে। দিল্লী থেকে লাটসাহেবের বস গেলে অবশ্য অর্থহীন ঝাণ্ডা হাতে নেওয়া ঘোড়সওয়ার পুলিশ দেখা যায়।
আর তখনকার দিনে? স্যার জন অ্যান্ডারসনের আমলে? চার ফটকে পুলিশ। ডজন ডজন পুলিশ। বেছে নেওয়া হিংস্র প্রকৃতির কিছু কনস্টেবল, দেশি সব ইন্সপেক্টর, অ্যাংলো অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। এ ছাড়া থাকত আর্মড পুলিশ। চারপাশে ঘোরাঘুরি করত গোয়েন্দা।
এখন তো রাজভবনের চারপাশের ফুটপাতে হকার বসে, দেওয়ালে পসার সাজায়। ছআনায় গেঞ্জি, আট আনার তিনটি রুমাল, সস্তায় বেনারসী পেয়ারা ও ভাগ্যগণনা করাবার জন্য আশে পাশের অফিসের বাবুরা তো এখন রাজভবনের ফুটপাতেই আসেন। শুধু বাবুরা কেন? লুকিয়ে চুরিয়ে হয়তো লাটসাহেবের বৌ বা বৌমাও আসেন।
বাংলার তখৎ-এ-তাউসে যখন এই কুখ্যাত অ্যান্ডারসন আসীন, তখন ইন্ডিয়ান মাছি-মশা পর্যন্ত গভর্নমেন্ট হাউসের চৌহদ্দিতে আসতে পারত না।
লেড়কি দুজন প্রথম প্রথম লাটসাহেবের কোনো পার্সোনাল আংরেজ অফিসারকে নিয়ে বাইরে যেতেন। এক, দো, ঘণ্টার জন্য। কিন্তু ওতে কি ওরা খুশি হয়?
কথাটা বলে রমজান একটু অর্থপূর্ণ হাসি হাসে।
গভর্নমেন্ট হাউসে নিত্য যেসব স্থানীয় ইংরেজরা আসা-যাওয়া করতেন, তাদের সঙ্গে মেয়ে দুটির খাতির শুরু হল।
সন্ধের আগে দুটি উন্মনা পাখি ঘরে ফিরে আসত সত্য কিন্তু প্রতীক্ষা করত ককটেল বা ডিনারের গেস্টদের জন্য।
হুইস্কির গেলাসটা চট পট ডান থেকে বাঁ হাতে নিয়ে মিঃ জেফারসন মাথাটা একটু নীচু করে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন, ভেরি গ্ল্যাড টু মিট ইউ, মিস অ্যান্ডারসন। মিস অ্যান্ডারসন খুশি হয়ে একটু যেন হাসেন। ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে হ্যাঁন্ডসেক করেন, গ্ল্যাড টু মিট ইউ।
জেফারসন বড় খুশি হন। মিস অ্যান্ডারসনের হাতে গেলাস না দেখে উৎকণ্ঠিত হন; হোয়াট অ্যাবাউট ইওর ড্রিংকস?
কিছু চিন্তা করবেন না, আমি নেব এখন।
তাই কি হয়?
জেফারসন আর কথা না বলে থ্রোন রুমের ওই বিরাট পার্টির মধ্যে হারিয়ে যান! আবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুহাতে দুটি গেলাস নিয়ে হাজির হন অ্যান্ডারসনের সামনে।
দুটি গেলাস দেখে মিস অ্যান্ডারসনের বেশ মজা লাগে! কি ব্যাপার দুটি গেলাস?