ক্যাপ্টেন সাব, কি হয়নি এই গভর্নমেন্ট হাউসে। অ্যান্ডারসন সাহাব যখন লাটসাহেব তখন তার মেয়েকে বিয়ে কি গড়বড়ই না হল।
কি হয়েছিল?
কি হয়নি তাই বলুন। সুইসাইড পর্যন্ত হয়ে গেছে ওই লেড়কির জন্য।
কই তাতো কখনো শুনিনি।
এই রমজান ছাড়া আর কেসে কাহিনি বলবে বলুন। আমার চোখের সামনে হয়েছে…
জ্যাকসনের পর বাংলার গভর্নর হয়ে এলেন স্যার জন অ্যান্ডারসন। সঙ্গে এলেন লেডি অ্যান্ডারসন ও তার দুই মেয়ে। ছেলেটি পড়াশোনার জন্য বিলেতেই রইল। মেয়ে দুটির নাম রমজানের মনে নেই। ঠিক বয়স কত ছিল তাও মনে নেই। তবে মনে আছে মেয়ে দুটি সুন্দরী ও শিক্ষিতা ছিল এবং ওদের নিয়ে গভর্নমেন্ট হাউসের অফিসারদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য দেখা দেয়।
স্যার জন যখন কলকাতা এলেন, তখন ভারতবর্ষের রাজনীতিতে মোড় ঘুরেছে। ডালহৌসী বা ক্যানিং-এর যুগ বহুদিন আগে শেষ হয়েছে। রাউলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগ, খিলাফত আন্দোলন, এক প্রস্থ অসহযোগ আন্দোলনের ঝড় বয়ে গেছে ভারতবর্ষের ওপর দিয়ে। গুলি-গোলা, বোমা-পটকাও শুরু হয়েছে নানা দিকে। বাংলাদেশ তখন টগবগ করে ফুটছে। অ্যান্ডারসন সাহেবকে তাই গভর্নমেন্ট হাউসে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই সরকারি কাজে মন দিতে হল। মিলিটারি আর পুলিশ অফিসারদের নিয়ে বসতে হতো রোজ সকালে। ঘন ঘন দিল্লীতেও যেতে হতো শলা-পরামর্শের জন্যে।
চাকরি করতে এসে কেমন যেন ঘাবড়ে গিয়েছিলেন এই স্যার জন অ্যান্ডারসন। চব্বিশ ঘণ্টা সন্ত্রাসবাদীদের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত থাকতেন। গভর্নমেন্ট হাউসের বাইরে বেরুতেন না বিশেষ। লেডি অ্যান্ডান্সনও স্বামীর জন্য বড়ই চিন্তিত থাকতেন। তাইতো স্বামীর সান্নিধ্য তিনি বিশেষ ত্যাগ করতেন না।
মাঝখান থেকে বিপদে পড়ল মেয়ে দুটি। বিলেত থেকে সদ্য আগতা যুবতী মেয়েদের পক্ষে ওই গভর্নমেন্ট হাউসের মধ্যে বন্দিনী থাকা বিশেষ আনন্দের নয়। কদিন পরেই ওরা ছটফট করতে শুরু করল। লেডি অ্যান্ডারসন দু-চারদিন গঙ্গার ধার, ফোর্ট উইলিয়াম আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখবার পর মেয়েদের বললেন এই শহরে আর যেদিকে যাবে, সেখানেই টেরোরিস্টে ভর্তি। তাছাড়া ডার্টি সিটি! কি আর দেখবে?
মেয়ে দুটি কিন্তু ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারল না। একদিন সুযোগ সুবিধা মতো লাঞ্চের সময় একেবারে খোদ মিলিটারি সেক্রেটারিকে ওরা জিজ্ঞাসা করল, আমরা একটু বাইরে ঘোরাঘুরি করতে পারি না?
কেন পারবে না? কর্নেল উত্তর দেন।
ওই যে মা বললেন চারপাশে টেরোরিস্ট…
কর্নেল সাহেব হেসে বললেন, না, না, তোমাদের ওসব ভয় নেই। তবে গভর্নমেন্ট হাউসের গাড়ি চড়ে, পুলিশ নিয়ে ঘোরাঘুরি করলে বিপদ আছে। সাধারণ মেয়েদের মত ঘুরলে কেউ কিছু বলবে না। বরং ইউ কান্ট গেট এ মোর ফ্রেন্ডলি প্লেস দ্যান দিস সিটি!
রমজান বলল, ব্যাস! উসকে বাদ লেড়কিদের আর গভর্নমেন্ট হাউসে দেখাই যেতো না। কোনোদিন লাঞ্চ খেতেন না, কোনোদিন ডিনার খেতেন না। আবার কোনো কোনো দিন পিকচার দেখে রাত বারোটার পরে গভর্নমেন্ট হাউসে ফিরতেন।
ক্যাপ্টেন রায় জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা একলা একলাই ঘুরে বেড়াত?
রমজান হেসে ফেলে, আরে সাব, জোয়ান লেড়কি কভি আকেলে আকেলে ঘোরাঘুরি করে?
০৩. প্রবাসী বাঙালি হলেও
প্রবাসী বাঙালি হলেও বাঙালি তো বটে। বাংলাদেশের ইতিহাস পুরোটা না জানলেও কিছু কিছু তো জানেন ক্যাপ্টেন রায়। কিছু পড়েছেন কিছু শুনেছেন। স্যার জন অ্যান্ডারসনের নাম তাঁর কাছে অজ্ঞাত নয়।
হাজার হোক এলাহাবাদের ছেলে। মেদিনীপুর, ঢাকা, কুমিল্লা থেকে অনেক দূর। তবুও যে বাংলা, পাঞ্জাব আর মহারাষ্ট্র ইংরেজ সাম্রাজ্যের বনিয়াদ ধরে টান দিয়েছিল সেই অগ্নিক্ষরা দিনগুলিতে এলাহাবাদ ছিল তাদের কেন্দ্রবিন্দু। মিলনক্ষেত্র। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতীর পুণ্য সঙ্গম এই এলাহাবাদ। ধর্মক্ষেত্র ভারতবর্ষের প্রয়াগ তীর্থ। আধুনিক ভারততীর্থের পুণ্যভূমি। স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম মর্মস্থল।
স্যার স্টেইনলি জ্যাকসনের নামটা ঠিক মনে না থাকলে অ্যান্ডারসন সাহেবের নাম বেশ মনে আছে। তিরিশের বাংলাদেশ-বিপ্লবের ভরা যৌবন! সেদিনের কাহিনিতে অ্যাভরসন সাহেবের বার বার উল্লেখ জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন কিশোর-কিশোরী যুবক-যুবতীদের বার বার নজর পড়ছে এই ঘৃণা নায়কের দিকে।
রমজান অত শত জানে না, বুঝে না। তবে সে জানে, মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে অ্যান্ডারসন সাহেবের মনের আগুন, অন্তরের জ্বালা।
অ্যান্ডারসন সাহেবের বড় গুস্সা ছিল। এই আপনাদের বাঙালিদের উনি বরদাস্ত করতে পারতেন না।
ক্যাপ্টেন রায় ছোট্ট প্রশ্ন করেন কেন?
রমজান আবার বলে, এখনকার মতো তখন হিন্দী বা উর্দু আখবার পাওয়া যেত না। আংরেজি পেপারই শুধু গভর্নমেন্ট হাউসে থাকত। তাছাড়া আমাদের পেপার পড়ার পারমিশান ভি ছিল না।
আচ্ছা? অবাক হন এ-ডি-সি।
অর কিয়া? রমজান একটু হাসে। আমি কি এমনি এমনি বলি জামানা বদলে গেছে? জামানা বহুত বদল গ্যায়া সাব!
খবরের কাগজ পড়তে পারত না রমজানের দল। তবুও খবর পৌঁছে যেত ওদের কাছে। পাষাণে গাঁথা পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে যেমন চুঁইয়ে চুঁইয়ে বিন্দু বিন্দু জল বেরিয়ে আসে, ঠিক তেমনি করে গভর্নমেন্ট অফিসের সতর্ক দৃষ্টির অজ্ঞাতসারেই আসত মেদিনীপুর, ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রামের খবর। খবর আসত পাঞ্জাব থেকে, মহারাষ্ট্র থেকে; এই কলকাতার গভর্নমেন্ট হাউসে। বসেই শোনা গিয়েছিল জালিয়ানওয়ালাবাগের সর্বনাশা কাহিনি। বড় বড় রাজকর্মচারীর ফিস ফিস করে আলোচনা করত পাঞ্জাবের গভর্নর মাইকেল ও ডায়ার ও তার সহচর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হ্যারি ডায়ারের কীর্তি। অমর কীর্তি। বিশ্ববিশ্রুত কীর্তি।