হাঁ সাব, করিব তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর হবে বৈকি।
তবে তুমি বাংলা বলতে পার না কেন?
হাসতে হাসতে রমজান বলে, এহি বাত সাব?
রমজান হারিয়ে যায় সেই সুদূর অতীতে। স্কুল-কলেজের কিছু ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় পাশ করার জন্য সেসব দিনের দুচার পাতা ইতিহাস মুখস্থ করলেও আর সবাই ভুলে গেছে। কলকাতা শহরের রাস্তা থেকে মুছে গেছে সেসব দিনের স্মৃতি। সেদিনের এসপ্লানেড, হেস্টিংস, ডালহৌসীর চরিত্র চেহারা হারিয়ে গেছে। কলকাতার মানুষ ভুলে গেছে কারমাইকেল, রোনাল্ডসে, স্টেইনলি, জ্যাকসন, অ্যান্ডারসন, ব্রেবোর্নের কথা।
রমজান যেন ক্যাপ্টেন রায়ের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই রাজভবনটা পুরো একটা চক্কর দিয়ে আসে। কুর্নিস করে আসে রোনাল্ডসে, স্টেইনলি জ্যাকসন, অ্যান্ডারসনকে।
সাব, বাংলা জানে বৈকি! তবে আমি তো পুরান জমানার লোক। আংরেজি ছাড়া আর কিছু চলত না এই গভর্নমেন্ট হাউসে।
ফর্ক দিয়ে এক টুকরো রুটি মুখে পুরে ক্যাপ্টেন রায় রমজানের কথা শোনেন। একটু যেন অবাক হয়েই পুরান জমানার কথা শোনেন।
ক্যাপ্টেন সাব, আমি যখন ছোঁকরা বয়েসে নোকরিতে ঢুকি, তখন বাঙালিবাবুরা এই গভর্নমেন্ট হাউসে ঢুকতে পেত না…
কেন যাঁরা গভর্নমেন্ট হাউসের অফিসেই কাজ করতেন?
না, তারাও না। সাধারণ বাঙালি কেরানীবাবুরাও অন্দরে আসতে পারতেন না। কার্জন সাহেবের আমলে বাংলা দুটুকরা করার সময় যে মুভমেন্ট হল, তাতে আংরেজদের বড় ডর লেগেছিল। বাঙালি পুলিশ পর্যন্ত এই গভর্নমেন্ট হাউসে ডিউটি দিতে পারত না।
আচ্ছা?
জি সাব।
চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিতে দিতে ক্যাপ্টেন রায় জানতে চাইলেন, তুমি চাকরি পেলে কি ভাবে?
সে তো আর এক কাহানি। তবে তখন আপকান্ট্রি মুসলমানদের নোকরি মিলত। আমার এক চাচা জ্যাকসন সাহেবের এক দোস্তের খাস বেয়ারা ছিল। সেই সাহেবের দয়াতেই আমি ছোঁকরা বয়সে গভর্নমেন্ট হাউসে নোকরি পাই।
ভারি মজা লাগে রমজানের কথা শুনতে। তা তুমি ছোঁকরা বয়সে কি কাজ করতে?
এই কলকাত্তা শহরের বড় বড় সাহাবদের মেমসাহেবদের দল রোজ সকালে হেস্টিংসের মাঠে গলফ খেলতে যেতেন। কোনো কোনোদিন লাটসাহেবের মেমসাহেবও যেতেন। আমি যেতাম মেমসাহেবদের সঙ্গে বল কুড়িয়ে দেবার জন্য।
কথাগুলো বলতে বলতে রমজানের চোখমুখগুলো একটু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যেন একটু গর্ব হয় সেদিনের স্মৃতি রোম-হন করতে।
মেমসাহেব আমাকে খুব পসন্দ করতেন…
আর এক পেয়ালা চা শেষ করে ক্যাপ্টেন রায় প্রশ্ন করেন, কেন?
রমজান হঠাৎ একটু হাসে। একটু যেন জোরেই হাসে। রাজভবনের শান্ত শীতল, প্রাণহীন পরিবেশে সে হাসি যেন বেমানান।
ক্যাপ্টেন একটু বিস্মিত না হয়ে পারেন না। কি ব্যাপার, হাসছ কেন?
বড় মজা হতো ও জমানায়। রোজ সন্ধ্যার পর খানা-পিনার পার্টি হতো। এই কলকাতার সব বড় বড় সাহেবরা আসতেন দিল্লি, বিলাইতের সাহেবরাও আসতেন। লাচ, গান আর শরাব চলত রাত একটা, দুটো, তিনটা পর্যন্ত…
রোজ হতো?
হ্যাঁ সাব, রোজ। এখনকার মতো তখন লাটসাহেব রোজ লেকচার দিতে বাইরে যেতেন না। লাটসাহেব সাল মে দো-চোর বাইরে খানাপিনা করতেন। বাকি রোজ সন্ধ্যায় লাটসাহেবেই অন্যদের খানাপিনার পার্টি দিতেন। আর ওইসব পার্টিতে কি ভয়ানক বদমাইশি হতো…
ক্যাপ্টেন রায়ের আগ্রহ বাড়ে, কেন? পার্টিতে আবার কি বদমাইশি হতো?
ডান হাতটা কপালে ঠেকিয়ে বৃদ্ধ রমজান বলে, আরে সাব! মাত পুছিয়ে। বোতল বোতল শরাব খাবার পর কি আর হুশ থাকে? সাহেব-মেমসাহেবরা বেহুশ হবার পর বদমাইশি হতো।
রমজান একটু থেমে আবার ঠিক করে মনে করে নেয়।
সাহাব-মেমসাহাবের দল বেহুশ হবার পর বেয়ারা-চাপরাশীরা মজা শুরু করত। কেউ শরাব খেত, কেউ চোরি করত, কেউ আবার…
রমজান আর এগোতে পারে না। বলতেও দ্বিধা হয়, সঙ্কোচ হয়। লজ্জাও করে ঘৃণাও করে।
ক্যাপ্টেন রায়ের বুঝতে অসুবিধা হয় না।
তা মেমসাহেব তোমাকে কেন ভালোবাসতেন?
আমি ছোঁকরা ছিলাম বলে ওদের চোরি করাতে আমার ডর লাগত, খারাপ লাগত। পারলে ওদের চোরির জিনিস আমি ফিরিয়ে দিতাম। মেমসাহেবকে সাবধান করে দিতাম। তাইতো…
শুধু সেদিন সকালে নয় আরো কতদিন বসে বসে এই গভর্নমেন্ট হাউসের কত কাহিনি শোনেন ক্যাপ্টেন রায়। আজকের রাজভবনের সঙ্গে সেদিনের গর্ভনমেন্ট হাউসের কত পার্থক্য। এক যুগ নয়, বহু যুগের ব্যবধান। ইউনিয়ন জ্যাক থেকে তেরঙ্গা। ভারতবর্ষের ইতিহাসের অনন্য স্মৃতি লুকিয়ে আছে এই রাজভবনের সর্বত্র। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডাইরেক্টরদের সঙ্গে লর্ড ওয়েলেসলির ঐতিহাসিক ঝগড়া হয় রাজভবনে। মেকলের সঙ্গে বেন্টিক-এর বির্তক হয় ওই পাশের কাউন্সিল চেম্বারে।
রমজান তখন গভর্নমেন্ট হাউসে চাকরি পায়নি, তবে শুনেছে। অনেকের কাছে শুনেছে। শুনেছে লর্ড ক্যানিং-এর কাহিনি। স্বেচ্ছাচারী ক্যানিং যখন এই গভর্নমেন্ট হাউসে ছিলেন তখন তার বিরুদ্ধে ঝড় উঠেছিল। কলকাতার ইংরেজরা ওই ওপাশের টাউন হলে বসে সভা করে দাবি জানিয়েছে, গো ব্যাক ক্যানিং। পরবর্তীকালে আই সি-এস লরেন্স লর্ড লরেন্স হয়ে গভর্নর জেনারেল হলে এই গভর্নমেন্ট হাউসের লনে ক্রিকেট খেলেছেন আর কলকাতার হাজার হাজার মানুষ সে খেলা দেখে হাততালি দিয়েছে শীতকালের দুপুরে।