প্রথম প্রথম কষ্ট হয়, অসহ্য মনে হতো ক্যাপ্টেনের। মনটা বিদ্রোহ করতে চাইত, সৈনিক হয়েও ধৈর্যচ্যুতি ঘটত কিন্তু মডার্ন সোসাইটির সৌজন্য বজায় রাখবার জন্য কিছু করতে পারত না। প্রায় মুখ বুজে সহ্য করত।
লাইটারের আগুনটা অমন দপ করে, দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠায় ক্যাপ্টেন মুখ সরিয়ে নিয়েছিলেন সিগারেটটা জ্বালাতে পারেননি। ফ্রেম কন্ট্রোলকে ঘুরিয়ে আবার লাইটারটা জ্বালিয়ে সিগারেট ধরালেন ক্যাপ্টেন। প্রায় অদৃশ্য এক শিখা! মুহূর্তের জন্য বেশ লাগল দেখতে। শুধু যেন একটা ইঙ্গিত, একটা ইসারা। একটা নিমন্ত্রণ। একটা স্বপ্ন, একটা আশা। ভবিষ্যতের প্রত্যাশা।
মোগলের প্রাসাদ বা আলাউদ্দীন খিলজীর হারেমের অনতিদূরে বসে নয়। যমুনা পারে গুলবাহারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পারস্য-সুন্দরীদের দেখতে দেখতেও নয়, ডালহৌসী পাড়ার রাজভবনে বসে বসেই ক্যাপ্টেন রায়ের মনটা যেন একটু চঞ্চল হয়। একটু বিচলিত হয়।
সরকারি বা বেসরকারি দপ্তরে বসে মন চঞ্চল হতে পারে না। চারপাশে লোকজন গিজ গিজ করছে। বক বক করতে হয় সারাক্ষণ। তাছাড়া পরিবেশ।
রাজভবনে তো সে বালাই নেই। এ-ডি-সি-র অফিস থেকে জানলা দিয়ে দেখা যায় ফুলের জলসা, সবুজের মেলা।
আর?
আর দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ। দুটো ডানায় ভর দিয়ে উড়ে বেড়ায় ছোট্ট ছোট্ট পাখি। কতটুকুই বা ওদের প্রাণশক্তি? কতটুকুই বা সামর্থ্য? তবুও স্বপ্ন দেখার শেষ নেই। অফুরন্ত ওদের সাধ। উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায় সীমাহীন নীল আকাশের বুকে।
রাজভবনে ওই দপ্তরে বসে নীল আকাশ দেখতে দেখতে ক্যাপ্টেনও উড়ে ঘুরে বেড়ান দিগন্ত বিস্তৃত পরিচিতের মহাকাশে। এ যেন সেই পথ হারানোর অধীন টানে অকুলে পথ আপনি টানে।
সিগারেটে একটা টান দেন। একবার লাইটার দেখেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দৃষ্টিটা ঘুরে আসে ফুলের জলসায়, সবুজের মেলায়, নীল আকাশের কোলে।
পর পর দুটো টান দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরিয়ে দিলেন ঘরটা, এ-ডি-সি ক্যাপ্টেন কমল রায়। রিভলবিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে একটা টি-পাই এর ওপর পা দুটো তুলে দিয়ে বাইরে চেয়ে রইলেন।
কি ভাবছিলেন কে জানে? হয়তো সতীনাথবাবুর কথা। হয়তো বিভ্রান্ত মন চাইছিল মণিকার আশ্রয়। হয়তো বা অন্য কিছু, অন্য কাউকে!
হঠাৎ লাল আলোর ঝলকানি অনুভব করতেই মুহূর্তের মধ্যে মাথায় টুপি চাপিয়ে এ-ডি-সি ক্যাপ্টেন রায় ছুটে গেলেন গভর্নরের কাছে।
মর্নিং ভিজিটার্স চলে যাবার পর রাজভবনের প্রথম অধিবেশন শেষ হয়। খুব জরুরী কাজ থাকলে অবশ্য রাজ্যপালকে পাঁচ-দশ মিনিট আরো থাকতে হয়। জরুরী কাজ মানে কয়েকটা দস্তখত। অটোগ্রাফ। নিজের বিচার, বুদ্ধি, বিবেচনা-কিছুরই প্রয়োজন নেই। কোনো চিন্তাভাবনা না করেই রাজ্যপালকে অর্ডিন্যান্স বা বিল বা অন্য কোনো দলিলে দস্তখত দিতে হয়।
এমন ধরনের জরুরী কাগজপত্রে রাজ্যপালের দস্তখত দরকার হলে মর্নিং ভিজিটার্স চলে যাবার পর সেক্রেটারি টু দি গভর্নর নিয়ে আসেন এইসব কাগজপত্র। পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই রাজ্যপালের বিবেচনার পর্ব শেষ হয়। তারপর দস্তখত। অটোগ্রাফ।
গভর্নর অন্দরমহলে প্রস্থান করলে রাজভবনের প্রাণহীন নাটকের প্রথম অঙ্ক শেষ হয়।
এ-ডি-সি ফিরে আসেন নিজের অফিসে। রিভলবিং চেয়ারে দেহটা এলিয়ে পা দুটো তুলে দেন টেবিলের ওপরে। অশোকস্তম্ভ মার্কা সিগারেট ধরিয়ে ভর্তি করে দেন ঘরটা।
দুটো একটা টান দিতে না দিতেই পিছনের ওই বিরাট জানলা দিয়ে একটা দমকা হাওয়া আসে। সিগারেটের ধোঁয়া কোথায় হারিয়ে যায়, লুকিয়ে যায় ক্যাপ্টেন রায় তা নিজেই বুঝতে পারেন না। হাতের রনসন লাইটারটা বড় স্পষ্ট করে দেখতে পান।
ইতিমধ্যে বুড়ো রমজান এসে গেছে। রোজ যেমন আসে। এক পট দার্জিলিং টি, কিছু স্ন্যাকস, কিছু পেস্ট্রি, কিছু নাট নিয়ে। রমজান আপন মনে এক কাপ চা তৈরি করে এগিয়ে দেয় ক্যাপ্টেন রায়ের সামনে। লিজিয়ে সাব, চা খান।
লাইটারটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে সম্বিত ফিরে পান আনমনা ক্যাপ্টেন রায়। রমজানের কথা শুনে একটু মুচকি হাসেন।
কিঁউ সাব? হাসেন কেন? রমজান জানতে চায়।
সাধারণ বেয়ারা-চাপরাশীর দল অফিসারদের সঙ্গে ঠিক এভাবে কথা বলার সাহস বা প্রশ্রয় না পেলেও রাজভবনে এসব সম্ভব। এখানে বেয়ারা চাপরাশীরা যে বড় বেশি ঘনিষ্ঠ। বড় বেশি কাছের মানুষ। দু চোখ ভরে ওরা যে সবকিছু দেখেছে। মুখে কিছু বলে না, বলতে পারে না, বলতে চায় না। কিন্তু মনে মনে তো সবকিছু জানে, বোঝে।
তাছাড়া রমজানের কথা স্বতন্ত্র। রিটায়ার করার পর দু-দুবার এক্সটেনশন পেয়েছে স্বয়ং গভর্নরের সুপারিশে। রমজানের কনিষ্ঠ সহকর্মীরাও আপত্তি করেনি। বরং তাদেরই সম্মিলিত অনুরোধে রমজানের চাকরির মেয়াদ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। হয়তো ভবিষ্যতেও হবে।
প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে রমজান কাজ করছে এই রাজভবনে। নিজের হাতে কাজ শিখিয়েছে। তার সব তরুণ সহকর্মীদের। ওদের সবাইকে পুত্ৰতুল্য জ্ঞান করে প্রবীণ রমজান। রমজান। রাজভবনের প্রধানতম কর্মী। সবার কাছেই ওর বিশেষ মর্যাদা।
তাইতো এ-ডি-সি সাহেবের মুচকি হাসি দেখে রমজান তার কারণ জিজ্ঞাসা করতে পারে।
ক্যাপ্টেন রায় জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা রমজান তুমি তো প্রায় তিরিশ-চল্লিশ বছর এই কলকাতা শহরের এই রাজভবনে কাটালে।