মণিকা একটু উতলা হয়ে পড়ে, তারপর?
খুব ধুমধাম করে বিয়ে-বৌভাতও হল। মানিকের একদম ছুটি ছিল না বলে বৌভাতের পরের দিনই চলে গেল পাঠানকোট।
মণিকা পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে শুনল।
মাস খানেক বেশ কাটল। খুব আনন্দে কাটল। কিন্তু তারপর একদিন কয়েক মিনিটের মধ্যে…
থেমে গেলেন। আর যেন বলতে পারছিলেন না। গলার স্বরটা আরো ভারি হয়ে উঠেছিল। লজ্জায়, ঘেন্নায়, দুঃখে কিছুক্ষণ বাক-শক্তি রহিত হয়ে বসে রইলেন।
না, না, চুপ করে বসে থাকলে চলবে কেন? এই রাত্রির অন্ধকারের মধ্যেই সব কিছু বলতে হবে, সব কিছু ফয়সালা করতে হবে।
…আমি গঙ্গা পুজো দিতে গিয়েছিলাম ত্রিবেণীতে। সঙ্গমে সন্ধ্যার সময় একলা একলা যাওয়া ঠিক হবে না বলে চাকরটাও গিয়েছিল আমার সঙ্গে। ফাঁকা বাড়িতে শুধু পুত্রবধূকে পেয়ে ওর মাথায় যে কি ভূত চাপল, জানি না। হঠাৎ উত্তেজনায় উনি কয়েক মুহূর্তের জন্য পশু হয়ে গিয়েছিলেন।…
আবার একটু থামতে গিয়েছিলেন। উত্তেজনায় সারা শরীর কাঁপছে। গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছে। তবুও থামতে পারলেন না।
…এই কলঙ্ক নিয়ে মেয়েটা বাঁচতে চাইল না। আলমারির লকার থেকে রিভলভার বের করে নিজেকে শেষ করে দিল…
মণিকা তাড়াতাড়ি দুহাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, সে কি?
হ্যাঁ মা।
এখানেই শেষ করেননি সে সর্বনাশা কাহিনি। বলেছিলেন কিভাবে সব ব্যাপারটা ধামা চাপা দেওয়া হয়। দুনিয়ার সবাই জানল, জাস্টিস রায়ের পুত্রবধু হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে কিন্তু স্তম্ভিত জাস্টিস রায় স্ত্রীর কাছে, একমাত্র পুত্রের কাছে সব কথা বলেছিলেন। নিজের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা ভিক্ষা করেছিলেন।
জানো মা, ওর মতো দেবতুল্য মানুষ হয় না। কিন্তু তবুও কেমন করে মুহূর্তের উত্তেজনায় উনি এমন কাজ করলেন, তা ভেবে পাই না। মানিককে উনি নিজের প্রাণের চাইতেও ভালোবাসেন। তবুও এসব হল কেমন করে, ভেবে পাই না।
কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন বৃদ্ধা।
তারপর থেকে মানিক আর এলাহাবাদ যায়নি। আর ওর বাবার অবস্থা দেখলে তুমি চোখের জল রাখতে পারবে না। এত বড় অন্যায় করেও কোনো শাস্তি না পেয়ে মানুষটা যে কিভাবে তিলে তিলে দগ্ধ হচ্ছে, প্রতি মুহূর্ত জ্বলেপুড়ে মরছে, তা তুমি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না মা…
মণিকাও স্থির থাকতে পারেনি। রায় পরিবারের সর্বনাশা কাহিনি শুনতে শুনতে চোখের দৃষ্টিটা ঝাঁপসা হয়ে গেছে।
এই অর্ধমৃত স্বামী আর ঘর ছাড়া পুত্র নিয়ে আমি যে কিভাবে বেঁচে আছি, তা ভাবতে পার মা? মানিককে কি আমি কোনোদিন ঘরে ফিরিয়ে নিতে পারব না? ওর বাবা কি মৃত্যুর আগে আর মানিককে দেখতে পারবে না?…
না, না, আর না। আত্মসমর্পণ করতে লজ্জা কি? এই বাকি রাতটুকুর মধ্যে যদি আত্মসমর্পণ করে ক্ষমা না পাই, তবে তো ভোরের আলোয় মুখ দেখাতে পারব না।
দুহাত দিয়ে মণিকার মুখোনা চেপে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন, তুমি কি পার না মা আমাদের সবাইকে ক্ষমা করতে, আমাদের সবাইকে বাঁচাতে?
মণিকাও হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। ক্যাপ্টেনের মা-র বুকের মধ্যে নিজের মুখটা লুকিয়ে রেখে শুধু একবার চীৎকার করে বলে উঠল, মা!
মা?
মণিকা আবার কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল, অমন করে কাঁদতে নেই মা!
মা?
আমি তোমার মা? তুমি আমাকে মা বলে ডাকলে? তুমি কি আমাদের ক্ষমা করলে মণিকা? মণিকা আর একটি কথারও জবাব দিতে পারল না।
অনেকক্ষণ কেটে গেল।
একটু আলোটা জ্বালবে মা?
কেন?
তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছে মা।
মণিকা তবুও চুপ করে বুকের মধ্যে মুখটা লুকিয়ে রেখে পড়ে থাকে। ক্যাপ্টেনের মা আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, একটু আলোটা জ্বাল না মা! তোমাকে যে ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছে।
নববধূর মতো দ্বিধা সংকোচে ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে আলো জ্বেলেই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।
ক্যাপ্টেনের মা তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে নিজের চোখের জল মুছে উঠে গেলেন মণিকার কাছে। আঁচল দিয়ে মণিকার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে ওর কপালে একটা চুমু খেলেন।
মণিকা ঝপাং করে একবার ওর পা ছুঁয়ে প্রণাম করেই দুহাত দিয়ে গলাটা জড়িয়ে ধরল।
আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। আনন্দেও দুজনের চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
হঠাৎ মণিকার মুখটা তুলে ধরে বললেন, একটা জিনিস দেখবে?
কি?
এসো।
নিজেই নিজের স্যুটকেসটা খুলে কাপড়-চোপড়ের নীচে থেকে একটা ফটো বের করে বললেন, মানিক কমিশন অফিসার হবার পর ওর বাবার সঙ্গে এই ছবিটা তোলা হয়।
মণিকা একটু অবাক হয়েই ফটোটা দেখল। পুত্রের গর্বে জাস্টিস রায়ের চোখ মুখ জ্বল জ্বল করছে। অথচ এই মানুষটাই…।
দুর্ঘটনা কার জীবনে কখন ঘটে যায় তা বলা যায়?
হঠাৎ দুজনের খেয়াল হল পূর্বের আকাশটা ফর্সা হয়ে উঠেছে। মণিকা সুইচটা অফ করে দিয়ে বলল, মা, এসব কথা কিন্তু আমার বাবা-মা বা অন্য কাউকে বলবেন না।
আচ্ছা।
আর এলাহাবাদে গিয়েই একবার বাবাকে পাঠিয়ে দেবেন।
দেব?
নিশ্চয়ই! কয়েকটা মুহূর্তেই দুর্ঘটনা ঘটে কিন্তু ওই কটা মুহূর্তটা তো জীবন নয়। জীবন অনেক বড়। অনেক ব্যাপ্ত।
.
তিন মাস পর।
ক্যাপ্টেন, আর্মি হেড কোয়াটার্সে ট্রান্সফার হল। ইমিডিয়েটলি জয়েন করতে হবে। তাইতো বাসা ভাড়া করে কলকাতাতেই সব কাজ সেরে নেওয়া হল।