…ওরা বাব জাজ হয়েও বিচারে ভুল করেছেন কিন্তু মানিক?…
আবার থামলেন। আবার বললেন, অসম্ভব।
মণিকাটা চুপ করে শুয়ে আছে। মুখোমুখি।
মানিক যে বিচারে ভুল করে না, তার প্রমাণ চাও?
মণিকা হাসল। আপনি মা হয়ে ওকে বেশি চিনবেন, না কি আমি?
প্রফেসর মঙকে দেখাশুনা করতে গিয়ে যখন তোমার সঙ্গে, তোমার বাবা-মার সঙ্গে ওর আলাপ হল তখনই আমাকে জানাল। আজ সারাদিন তোমাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে ওর সেই চিঠিটার কথা ভাবছিলাম।
কেন?
আলোটা জ্বাল।
মণিকা উঠল। আলোটা জ্বালল।
আমার স্যুটকেসটা খোল।
মণিকা সুটকেসটা খুলতেই বললেন, উপরের শাড়িটার তলায় একটা লম্বা খাম আছে না?
শাড়িটা তুলতেই খাম পেল।
এদিকে নিয়ে এসো।
মণিকা খামটা নিয়ে খাটের উপর বসল।
ক্যাপ্টেনের মা বললেন, ভেতরের চিঠিটা পড়ে দেখ।
আপনার চিঠি আমি পড়ব?
পড় না। মার কাছে লেখা ছেলের চিঠি পড়তে লজ্জা কি?
ছোট্ট চিঠি।-প্রফেসর মঙ যে আসছেন, সেকথা তোমাকে আগেই জানিয়েছি। সেদিন ওই বৃদ্ধ অধ্যাপককে দেখতে গিয়ে আলাপ হল একটা বাঙালি মেয়ের সঙ্গে। মণিকা ব্যানার্জি। তারপর ওর বাবা-মার সঙ্গে। ডক্টর ব্যানার্জি রেঙ্গুন ইউনিভার্সিটিতে ছিলেন এবং সেই সূত্রে ওদের আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা। তুমি তো জান আমি তোমার কোলের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারলেই সবচাইতে ভালো থাকি। খুব বেশি লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে আমার মোটেও ভালো লাগে না, পছন্দও করি না। বিশেষ করে মেয়েদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে আমার অনেক দ্বিধা অনেক ভয়। তবুও ওদের সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করলাম। ডক্টর ব্যানার্জি দেবতুল্য লোক আর ওর স্ত্রী? মাসিমা? তোমার দ্বিতীয় সংস্করণ। তোমার এই হ্যাংলা ছেলেটাকে কি আদর-যত্ন করেই খাওয়ান।…
চিঠিটা পড়তে পড়তেই মণিকা হাসল।
হাসছ কেন?
এইসব হ্যাংলা-ট্যাংলা লেখার কোন মানে হয়।
উনিও হাসতে হাসতে বললেন, ওর কথা বাদ দাও।
মণিকা আবার চিঠিটা পড়তে শুরু করল…মণিকা? রূপ-যৌবন শিক্ষা-দীক্ষা থাকা সত্ত্বেও কৃষ্ণচূড়ার মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নিজের অহমিকা প্রচার করতে শেখেনি কিন্তু কাছে এলেই রজীনগন্ধার মতো সৌরভে ভরিয়ে দেয় সবাইকে। গভীরতা আছে কিন্তু উচ্ছলতা নেই। তুমি যখন কলকাতা আসবে, তখন আলাপ করিয়ে দেব। নিশ্চয়ই ওদের সবাইকে তোমার ভালো লাগবে।…
চিঠিটা পড়া শেষ হল। তবুও মণিকা মনে মনে আবৃত্তি করল, কৃষ্ণচূড়ার মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নিজের অহমিকা প্রচার করতে শেখেনি কিন্তু কাছে এলেই রজনীগন্ধার মতো সৌরভে ভরিয়ে দেয় সবাইকে।
চিঠিটা খামে ভরে আবার সুটকেসের মধ্যে রেখে সুইচটা অফ করল। ক্যাপ্টেনের মা-র পাশে শুয়ে পড়ল।
তোমাদের সঙ্গে দুচার দিন মেলামেশা করেই ওই চিঠি লিখেছিল…
রাত্রিতে নিস্তব্ধতার মধ্যে দুজনে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ক্যাপ্টেনের মা বললেন, অনেক আশা নিয়ে তোমার কাছে এসেছি কিন্তু…
গলা দিয়ে যেন কথা বেরুতে পারল না।
মণিকা একটু অস্থির, একটু চঞ্চল হয়ে উঠল, কিন্তু কি…
তুমি কি আমাদের ক্ষমা করতে পারবে?
একি বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি মা।
মণিকা একটু থতমত খায়। তবু বলে, আপনারা আবার অন্যায় কি করলেন যে ক্ষমা চাইছেন?
হয়তো ইচ্ছা করে করিনি কিন্তু ঘটনাচক্রে অন্যায় করেছি বৈকি।
গলার স্বরটা ভেজা ভেজা। হয়তো দুএক ফোঁটা চোখের জল পড়তেও শুরু করেছে। মণিকা সাহস দেবার জন্য বলল, কিছু না কিছু অন্যায় সব মানুষেই করে তার জন্য এত…
ঘটনাটা যে বড়ই লজ্জার, বড়ই দুঃখের।
ওই অন্ধকারের মধ্যে ছলছল জলভরা কাতর দুটি চোখ দেখতে পেল মণিকা। ওসব ভুলে যান। অত চিন্তা করার কি আছে?
তুমি ক্ষমা করলে, তুমি ভিক্ষা দিলে হয়তো সত্যি ভুলে যাব, হয়তো…
ছি ছি, আপনি অমন করে বলবেন না। মণিকা দুটি হাত দিয়ে বৃদ্ধার দুটি হাত চেপে ধরল।
এই রাত্রির অন্ধকারেও তোমাকে সে কথা বলতে ভয় করছে, লজ্জা করছে…
কি দরকার সে কথা বলার?
তোমাকে না বললে তো চলবে না মা।
আমাকে?
হ্যাঁ মা।
মণিকা ঘাবড়ে গেল। আপনি কাঁদছেন?
মণিকা তাড়াতাড়ি উঠে বসে হাত দিয়ে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিল। আপনি একটু ঘুমোন।
সারাটা বুকের মধ্যে তোলপাড় করছে। তোমাকে সবকথা না বলা পর্যন্ত আমার চোখে ঘুম আসবে না।
বলুন না কি কথা।
বলব?
নিশ্চয়ই।
সবকথা শোনার পর আমাকে, মানিককে, মানিকের বাবাকে ক্ষমা করতে পারবে কি? ঘেন্নায় আমাদের দূরে ঠেলে দেবে না তো?
মণিক দুহাত দিয়ে ক্যাপ্টেনের মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার ওইসব কথা বলছেন?
বলব না মা?
রাত্রি আরো গম্ভীর হল। গম্ভীর হল দুটি প্রাণ, দুটি মন ক্যাপ্টেনের মা আর দূরে সরে থাকতে পারলেন না, লুকিয়ে রাখতে পারলেন না মনের কথা।
…তিন পুরুষ ধরে এলাহাবাদে ওদের বাস। যথেষ্ট সম্মান সম্রম নিয়েই বাস করছিলেন। আজও সে সম্মান সম্রম নষ্ট হয়নি সত্য কিন্তু হঠাৎ একটা ভূমিকম্পে সারা সংসারটা ভেঙেচুরে ছারখার হয়ে গেল।
ভূমিকম্প?
তার চাইতেও খারাপ মা। মানিক কমিশনড়…অফিসার হল। ওর বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগে পড়লাম আমরা দুজনে। বেনারসের একটা মেয়ে পছন্দ করা হল। বাবা-মা নেই। গরিব মাসির কাছে মানুষ হয়েছে। দেখতে শুনতেও বেশ। তাছাড়া বি-এ পাশ ছিল। জাস্টিস রায়ের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে শুনে ওরা তো হাতে স্বর্গ পেলেন।…