তা আমি জানি।
মণিকা ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ ফিরে চাইল। আপনি জানেন?
হ্যাঁ মা। আমি জানি। মানিক আমাকে সব কিছু লেখে।
সব কিছু? মণিকা লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠে।
আমি তোমার এই ঘরে তোমার কাছেই থাকব কেমন?
নিশ্চয়ই।
তাছাড়া এ বাড়িতে তুমিই তো আমার সব চাইতে আপন।
মণিকা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।
ক্যাপ্টেনের মা এবার মণিকার মুখোনা তুলে ধরে বললেন, সত্যি বলছি মা। মানিকের চিন্তায় আমি রাত্রে ঘুমুতে পারি না। কোন দোষ না করলেও ভগবান ওকে বড় শাস্তি দিয়েছেন।
মণিকা একবার মুহূর্তের জন্যে ওর দিকে তাকিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিল।
ক্যাপ্টেনের মা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।
মণিকা কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারল না কিন্তু অজস্র অজানা সম্ভাবনার জন্য বিশ্রী অস্বস্তিবোধ করল সারাদিন।
শুধু কি অস্বস্তি?
উৎকণ্ঠাও। ক্যাপ্টেনের জন্য একটা চাপা উৎকণ্ঠাও বোধ করল। জীবনে কী এমন আঘাত পেয়েছে ও? তাই কি ও এতটা সংযত, সংহত?
সমবেদনাও বোধ করল। মনটা ভীষণ নরম হয়ে গেল। নিজের সমস্ত অন্তর দিয়ে ভালোবেসে ওর অতীত জীবনের সব দুঃখ, সব অভাব মুছে ফেলে দিতে চাইল।
সারাটাদিন বেশ কাটল। হাসি, গল্প, গান। রেঙ্গুনের গল্প, এলাহাবাদের গল্প। ক্যাপ্টেনের ছোটবেলার গল্প। আরো কত কি। বুড়ো অধ্যাপক মঙকে নিয়েই কাটল বেশ কিছুক্ষণ।
ব্রেকফাস্টের পরেই ক্যাপ্টেন চলে গিয়েছিল গভর্নমেন্ট হাউসে। অনেক কাজ ছিল। তবুও ঘন্টায় ঘন্টায় টেলিফোন করছিল। মাকে, মাসিমাকে, মণিকাকে।
তুমি কখন বেরুবে?
কোথায় আর বেরুব?
বিজয়া মাসিমার সঙ্গে দেখা করবে না?
আজকে আর যাচ্ছি না।
এমনি তো একটু ঘুরতে বেরুবে।
নারে বাবা না। আজ আমি কোথাও বেরুব না। এদের সঙ্গে গল্পগুজব করি। কাল-পরশু দেখা যাবে।
ক্যাপ্টেন বুঝল জোর আড্ডা জমেছে। তাহলে আজ আর আমাকে দরকার নেই?
দরকার থাক আর নাই থাক, তোর কাজকর্ম শেষ হলে চলে আসিস।
পরে একবার মণিকাকে জিজ্ঞাসা করল, মাকে কেমন লাগছে?
তোমার চাইতে ভালো।
নিশ্চয়ই! সে বিষয়ে আবার ডাউট আছে নাকি? আফটার অল সি ইজ মাই মাদার।
তাই নাকি?
এক্সকিউজ মি ইওর এক্সেলেন্সি! ডু ইউ নিড ইওর এ-ডি-সি এনি টাইম টু-ডে?
মণিকা ফিস ফিস করে বলেছিল, আই ডোন্ট নিড ইউ বাট তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।
বিকেলে দিকে ক্যাপ্টেন এসেছিল। কিছুক্ষণ গুল্পগুজব করে চলে যাচ্ছিল। মা বললেন, আমার ফেরার টিকিটটা কাটতে ভুলিস না।
তুমি কবে যাবে?
ভাবছি পরশু চলে যাব।
মিসেস ব্যানার্জি প্রতিবাদ করলেন সঙ্গে সঙ্গে। তাই কি হয়? সপ্তাহ খানেক তত থাকুন, তারপর দেখা যাবে।
ওকে যে একলা রেখে এসেছি। বেশি দিন থাকি কি ভাবে?
হঠাৎ মণিকা বলে ফেলো, তাহলে এখন এলেন কেন?
কি করব মা? অনেকদিন ছেলেটাকে দেখি না; তাছাড়া তোমাদের দেখতেও ভীষণ ইচ্ছা করছিল।
মিসেস ব্যানার্জি বললেন, তাই বলে আপনি পরশু যেতে পারবেন না।
ক্যাপ্টেন বলল, তুমি বরং আজকের দিনটা চিন্তা কর। কাল আমাকে তোমার ডিসিশন জানিয়ে দিও।
তোর ওসব চালাকি ছাড়। এই করে করে তুই আমাকে সেবারের মতো করবি ভাবছিস, তাই না?
সত্যি সেবার মাকে মীরাটে আনিয়ে কি কাণ্ডটাই না করেছিল। আজ না কাল, কাল না পরশু করতে করতে তিন সপ্তাহ কাটিয়ে দিয়েছিল।
ক্যাপ্টেন চলে যাবার পর ওর মা মীরাট ষড়যন্ত্রের কাহিনিটা শোনালেন। মানিকটা যে কী, বুঝি না। এত বড়ো হল কিন্তু এখনও ছেলেমানুষি গেল না।
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর ডক্টর ব্যানার্জি স্টাডিতে বসে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব হল। অনেক কথার মাঝখানে ডক্টর ব্যানার্জি হঠাৎ বললেন, একটা ভালো ছেলের হাতে এই মেয়েটাকে তুলে দিতে পারলে আমরাও দুজনে বেরিয়ে পড়তে পারি।
ওর জন্য আর এত দুশ্চিন্তার কি আছে? মণিকার মতো মেয়েকে ঘরে নিতে পারলে অনেকেই খুশি হবেন।
ব্যস। ওই পর্যন্তই। দুপক্ষের কেউই আর এগোতে পারেননি। ডক্টর ব্যানার্জি তাড়াহুড়ো করতে চাননি। ক্যাপ্টেনের মা এগোতে পারেননি নিজের সংকোচের জন্য।
গল্পটল্প করে উপরে যেতে যেতে অনেক রাত হয়ে গেল।
আমার জন্য তোমার শুতে শুতে অনেক রাত হয়ে গেল, তাই নাম মা?
না, না, এমন কি রাত হল?
সেই শুরু।
ক্যাপ্টেনের মা শোবেন বলে মণিকার ঘরে নীচের থেকে একটা খাট এনে পাতা হয়েছে। দুটো সিঙ্গলবেডের খাটের মাঝে বেশ খানিকটা ফাঁক।
খাটটা একটু এগিয়ে নিই, কি বল মা! এত দূরে থাকলে তোমার সঙ্গে গল্প করব কেমন করে।
মণিকাই খাট দুটোকে টেনে পাশাপাশি করল।
দুজনেই শুয়ে পড়লেন।
তোমার এত কাছে শুলে তোমার অসুবিধে হবে না তো?
না, না, অসুবিধে হবে কেন? আমি তো ভেবেছিলাম এই একটা খাটেই শোব কিন্তু মা বললেন আপনার কষ্ট হবে।
তারপর কিছু মামুলি কথাবার্তা।
মানিকের চিঠিতে পড়তাম তোমরা খুব ভালো লোক কিন্তু সত্যি ভাবিনি তোমরা এত ভালো।
মণিকা প্রথমে কিছু জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে। একটু পরে বলে, নিশ্চয়ই খুব বাড়িয়ে বাড়িয়ে লেখেন।
খানিকটা লজ্জা-দ্বিধার সঙ্গে কথা কটা বলল। ক্যাপ্টেনের মা-র কাছে ক্যান্টেনকে কি বলে উল্লেখ করবে ভেবে পাচ্ছিল না। ক্যাপ্টেনকে ক্যাপ্টেন বলাটা উচিত মনে হল না। উনি বা ও বলতেও লজ্জা করল।
বাড়িয়ে লেখার ছেলে ও না! তুলাদণ্ডের বিচার করে ও কথা বলে, চিঠি লেখে…
কথাটা শেষ হবার আগেই একটা ছোট্ট দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।