ডাক্তার সাহেব একটু পরেই এলেন। ভালোভাবেই দেখলেন। না বুকে কোনো কমপ্লিকেশন নেই। সাডেন চেঞ্জ অফ ক্লাইমেট হয়েছে।
ক্যাপ্টেন বললে, কি কাণ্ড বলুন তো! এত রাত্তিরে আমজাদ আবার আপনাকে ডিসটার্ব করল।
না, না। ডিসটার্বের কি আছে? একটু হেসে বললেন, একটা ক্যাপসুল পাঠিয়ে দিচ্ছি একটু কিছু খাবার পর ওটা খেয়ে শুয়ে পড়ুন। কাল সকালে আবার আসব।
পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল টেলিফোনের রিং শুনে। রিসিভারটা তুলতেই অপারেটর বলল, স্যার, ট্রাংকল ফ্রম এলাহাবাদ।
অনেক দিন বাদ মা-র সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল। জানালেন, মণিকার মা-ও একটা সুন্দর চিঠি লিখেছেন। কালই জবাব দিয়েছি, হয়তো আজই পাবেন।
তুমি কি আসছ?
আসব না? আজই বোম্বে মেলে রওনা হচ্ছি তুই হাওড়ায় থাকবি তো?
ক্যাপ্টেন মজা করে বলল, আমাকে স্টেশনে যেতে হবে?
বাঁদরামি করিস না…
এলাহাবাদ ট্রাংক-অপারেটর জানাল, টাইম ইজ ওভার।
১৪. মা-র সঙ্গে কথা বলার পর
মা-র সঙ্গে কথা বলার পর ক্যাপ্টেনের খেয়াল হল, শরীরটা ঝরঝরে হয়েছে। মনেই হচ্ছে না গতকাল অসুস্থ ছিল। তাছাড়া মা-র আসার খবর পেয়ে যেন মনটাও বেশ খুশিতে ভরে গেল।
ক্যাপ্টেন উঠে গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়াল। ঝুঁকে দেখল গাছপালার পাতায় পাতায় সূর্যের আলো লুকোচুরি খেলছে। সামনের লতায় পাতায় শিশির খুঁজে না পেলেও রাত্রির শান্তি তখনও দিনের কল্লোলে একেবারে হারিয়ে যায়নি।
একটু জোরে জোরে নিশ্বাস নিল। বুকটা জুড়িয়ে গেল। গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়া যে তখনও কলকাতার লক্ষ লক্ষ মানুষের দীর্ঘনিশ্বাসের ভয়ে পালিয়ে যায়নি। বেশ লাগল।
বাতাস যেন ওর কানে কল্যাণের আগমনী বার্তা পৌঁছে দিয়ে গেল। ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে ক্যাপ্টেন মনের আনন্দে দু লাইন গানও গাইল-অরূপবীণা রূপের আড়ালে লুকিয়ে বাজে, সে বীণা আজি উঠিল বাজি হৃদয় মাঝে। অরূপবীণা…।
তাইতো! মণিকা বা মাসিমাকে তো বলা হল না মা আসছেন। আসছেন মানে? আজই, বোম্বে মেলে রওনা হচ্ছেন।
জানো মণিমালা, এক্ষুনি মা ট্রাংক কল করেছিলেন।
কি ব্যাপার?
তোমাকে দেখতে আসছেন…
সত্যি? বলে ফেলেই বোধহয় মণিকার ভীষণ লজ্জা হল। হয়তো এমন করে আগ্রহ দেখান ঠিক হয়নি। হয়তো বাবা-মা কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন। দাঁড়াও খবরটা মা-কেও দিচ্ছি।
খবরটা শুনে মণিকারও মাও খুশি হলেন। সত্যিই যে খুশি হয়েছিলেন, তা বোঝা গেল পরের দিন সকালে হাওড়া স্টেশনে।
ক্যাপ্টেন বেশ খানিকটা আগেই স্টেশনে পৌঁছেছিল। দমদমে একজন গেস্টকে সি-অফ করে সোজা এসেছিল। ফুল ইউনিফর্মে। সঙ্গে তকমা আঁটা উর্দিপরা অর্ডালি লখন সিং। রাজভবনের গাড়ি থেকে লখন সিং-কে নিয়ে নামতেই প্ল্যাটফর্মের কিছু লোক একবার দেখে নিল। জি-আর-পির একটা কনস্টেবল সেলামও দিল।
ক্যাপ্টেন গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট শেষ করল। একবার হাতের ঘড়িটা দেখল। ট্রেন আসতে মিনিট পনেরো বাকি। প্লাটফর্মে পায়চারি করার জন্য একটু এগোতেই ক্যাপ্টেন আবাক হয়ে গেল।
একি মাসিমা, আপনিও এসেছেন? এক মুহূর্ত থেমে জিজ্ঞাসা করল, কার সঙ্গে এলেন?
উনিও এসেছেন।
সে কি? মেলোমশাইও এসেছেন?
শুধু ক্যাপ্টেন নয়, ওর মা ট্রেন থেকে নেমেই ওদের পেয়ে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন। একি আপনারা কষ্ট করে এলেন কেন? মণিকাই তত নিয়ে যেতে পারত।
ডক্টর ব্যানার্জি বললেন, আপনি দয়া করে আমাদের ওখানে আসছেন আর আমরা আসব না।
মণিকার মা বললেন, আপনার কথা এত শুনেছি যে দেখার আগ্রহটা চেপে রাখতে পারলাম না?
ক্যাপ্টেনের মা বললেন, আমিও কি আপনাদের বিষয়ে কম জানি? আপনাদের না দেখলেও আপনারা আমার অপরিচিত নন।
একটু পরে জিজ্ঞাসা করলেন, মণিকা বাড়িতেই আছে?
ওর মা জানালেন, হ্যাঁ।
গাড়িতে মালপত্র চাপানো হতেই ওরা রওনা হলেন।
দুটো গাড়ি পর পর থামতেই মণিকা বেরিয়ে এসে ক্যাপ্টেনের মাকে প্রণাম করল। ওর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন, দীর্ঘজীবী হও মা!
সবাই মিলে ড্রইংরুমে গিয়ে বসে খোসগল্প শুরু করলেন। খানিকটা পরে মণিকার মা ভেতরে চলে গেলেন। নিশ্চয়ই সংসারের তদারকির জন্য। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে ক্যাপ্টেনের মাকে বললেন, আর এখন গল্প করবেন না! এবার হাত মুখ ধুয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিন।
ক্যাপ্টেন সঙ্গে সঙ্গে জানাল, মাসিমা, আমি যত বেশি খাই, আমার মা তত কম খান। ব্রেকফাস্ট-ট্রেকফাস্টের ঝামেলা মার নেই।
সে কি? এখন কিছু খাবেন না?
মিসেস ব্যানার্জি একটু অবাক হলেন।
সকালে আমি কিছু খাই না।
সারা রাত ট্রেন জার্নি করে এসে একটু কিছু মুখে দেবেন না, সে কি কথা?
ব্যানার্জি-দম্পতি সত্যি একটু অস্বস্তিবোধ করছিলেন। তাইতো ক্যাপ্টেন আবার বলল, স্নান-টান সেরে এক গেলাস সরবৎ ছাড়া আর কিছু খান না।
চলুন আপনারা ব্রেকফাস্ট খাবেন। আমি বসে বসে গল্প করব এখন।
এতক্ষণে মণিকা বলল, আপনি বরং স্নানটা সেরে নিন।
একটু গল্প-টল্প করি। তারপর স্নান করব এখন। এত ব্যস্ত হবার কিছু নেই।
মণিকার মা আবার ভেতরে চলে গেলেন। ক্যাপ্টেনের মা এবার মণিকাকে বললেন, চল মা, তোমাদের বাড়িটা ঘুরে দেখি।
মণিকা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আসুন।
একতলা ঘুরে দোতলায় গিয়ে মণিকা বলল, এটাই আমার ঘর।