মণিকা নিশ্চয়ই মনে মনে খুশি হয়। আপনমনে কি যেন ভাবে। হয়তো ভবিষ্যৎ জীবনের একটু হিসাব-নিকাশ করে নেয়।
স্লো-স্পিডে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। এক হাতেই ক্যাপ্টেন স্টিয়ারিং ধরে আছে। দুএক মিনিট কেটে গেল।
মাণিক চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, সত্যি?
মিথ্যার পর ভিত্তি করে তো তোমাকে পেতে চাই না। সব সত্য জানিয়েই তোমাকে চাইব।
তার মানে?
আমার সব কথা তোমাকে জানাব না?
কেন আমি কি সব কিছু জানি না?
আমি জোচ্চর-লম্পটও তো হতে পারি।
মণিকা রেগে যায়। বাজে বকো না।
দুজনের কেউই আর এগোয়নি। গাড়ি ঘোরাবার পরই কথার মোেড় ঘোরাল ক্যাপ্টেন। আচ্ছা তুমি আমজাদ-রমজানকে কি বলেছ?
কি বলেছি?
ক্যাপ্টেন সরাসরি সে কথার জবাব দেয় না। একটু হাসে। একবার ভালো করে মণিকাকে দেখে। আমি সিগারেট খেতে খেতে ঘুমোই বলে এত দুশ্চিন্তা?
মণিকা জবাব দেয় না।
বাঁ হাত দিয়ে ক্যাপ্টেন মণিকাকে একটু কাছে টেনে নেয়। মণিকা আপত্তি করে না। আমার জন্য তুমি এত ভাব?
একটু চুপ করে থেকে মণিকা বলে, শুধু আমি কেন? আরো অনেকেই নিশ্চয়ই ভাবেন।
অনেককেই আর কোথায় দেখলে?
এত কথা হল কিন্তু চিঠির কথা বলল না ক্যাপ্টেন। রাত্রে খেতে বসে মণিকার মাকে বলল, মাসিমা, এবার বোধহয় আমার মা আসছেন।
কবে আসছেন?
ঠিক জানি না তবে দুএক উইকের মধ্যেই।
মণিকা শুধু শুনল। কিছু বলল না।
ডক্টর ব্যানার্জি জানতে চাইলেন, তোমার বাবাও আসছেন?
বাবা যে কোনোদিন তার পুত্রের সামনে দাঁড়াতে পারবেন না, সে কথা কি বলতে পারে? না। এখন তো ওঁর হাইকোর্ট ভোলা।
মিসেস ব্যানার্জি বললেন, তোমার মাকে আবার রাজভবনেই তুলো না যেন। আমাদের এখানেই…
তুমি বরং কালকেই ওর মাকে একটা চিঠি লিখে দিও।
স্বামীর প্রস্তাবে সম্মতি জানালেন মিসেস ব্যানার্জি।
মনে মনে খুশি হলেও ক্যাপ্টেন বলল, না, না, ওসব ঝামেলার কি দরকার। মা আমার ওখানেই থাকবেন!
প্রতিবাদ করলেন ব্যানার্জি-দম্পতি, এতে আবার ঝামেলার কি আছে?
ওদের সামনে বেশ গাম্ভীর্য বজায় রাখলেও হঠাৎ ক্যাপ্টেনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, কিন্তু মণিকা কি তা পছন্দ করবে?
জবাব দেবে কি মণিকা? লজ্জায় জিভ কেটে তাকাল ক্যাপ্টেনের দিকে। ব্যানার্জি-দম্পতিও দৃষ্টি বিনিময় করলেন।
কি আর করবে ক্যাপ্টেন? একটু স্বাভাবিক হবার জন্য মণিকার মাকে বলল, আচ্ছা মাসিমা, তিনজন নিয়েই তো আপনার সংসার। আপনি আর মেলোমশাই মাকে এখানে থাকার কথা বললেন অথচ মণিকা একটা কথা বলল না…।
আর মণিকা চুপ করে থাকে না। রাজভবনের স্টাফদের সবাই কি মিন-মাইন্ডেড হয়?
পরের দিনই ক্যাপ্টেন গভর্নরের সঙ্গে দার্জিলিং চলে গেল। লেফটন্যান্ট ভাটিয়াকে গভর্নরের সব প্রোগ্রাম বুঝিয়ে দিয়েই ক্যাপ্টেন ফিরে এলো তিন দিনের দিন।
ফিরে এসেই ডাক দেখল। মা-র চিঠি না দেখে মনে একটু খটকা লাগল ক্যাপ্টেনের। তবে কি মা-র মত নেই? না, না, তা কেমন করে হয়? আমার মা-কে আমি চিনি না। তবে কি মা অসুস্থ? নাকি বাবাকে নিয়েই আবার কিছু হল?
সেই ঘটনার পর বাবার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই ক্যাপ্টেনের। নববর্ষ-বিজয়ার পোস্টকার্ডও আসে না, যায় না। মা-র চিঠিতে অনেক কথা, অনেক খবর থাকে কিন্তু বাবার বিষয়ে কিছু লেখেন না। তাইত বার বার ভাবছিল বাবাকে নিয়েই আবার কোনো ঝামেলা হল নাকি?
অন্যান্য চিঠিপত্র পড়তে না পড়তেই টেলিফোন এলো। গভর্নমেন্ট হাউস পি-বি-এক্স থেকে অপারেটর ফোন করছে। স্যার গতকাল এলাহাবাদ থেকে ট্রাংকল এসেছিল…।
অপারেটরকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসা করল, কলিং পার্টি কে ছিল?
আপনার মা।
মা?
ইয়েস স্যার।
কি বললেন?
আমি বলছি আপনি আজ ফিরবেন।
থ্যাঙ্ক ইউ।
খবরটা শুনে মনটা অনেক আশ্বস্ত হল কিন্তু শরীরটা ঠিক ভালো লাগছিল না। ভীষণ মাথা ধরেছিল। সারা গা-হাত-পা কেমন ব্যথা লাগছিল। এক কাপ কফি আর একটা স্যারিডন ট্যাবলেট খেয়ে একটু শুয়ে পড়ল। একটা সিগারেট ধরাল। দুচার টান দেবার পর আর সিগারেট খেতেও ইচ্ছা করল না। ফেলে দিল। ঘুমিয়ে পড়ল।
একটা নতুন বেয়ারা ডিনার এনে দরজা নক করল কয়েকবার। কোনো জবাব পেল না। ফিরে গেল। ট্রে ভর্তি ডিনার নিয়ে ফিরে যেতে দেখে আমজাদ জিজ্ঞাসা করল, সাব নেই হ্যায় কামরামে?
বোধহয় না। নক্ করেও জবাব পেলাম না।
আমজাদের সন্দেহ হল। এইতো একটু আগেই দার্জিলিং থেকে ফিরলেন। আবার এক্ষুনি বেরিয়ে যাবেন? এ-ডি-সি সব বাইরে গেল আমি তো দেখতে পেতাম। আমি দেখতে না পেলেও আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বলে যেতেন।
চলিয়ে মেরে সাথ। সাব শো গ্যায়া হোগা।
আমজাদ নক্ করেও জবাব পেল না। তারপর হাতলটা ঘোরাতেই দরজা খুলে গেল। হ্যাঁ, যা ভেবেছি তাই। সব টায়ার্ড হয়ে শুয়ে পড়েছেন।
নতুন বেয়ারাটা টেবিলে খাবার রাখল। আমজাদ আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে ডাকল, সাব, সাব!
ক্যাপ্টেন অঘোরে ঘুমুচ্ছে!
আমজাদ আবার ডাকল, সাব, খানা তৈয়ার হ্যায়। সাব!
ওরা জানে ক্যাপ্টেনের ঘুম খুব পাতলা। একবার ডাকলেই উঠে পড়েন। শরীর-টরীর খারাপ হয়নি তো? সন্দেহ হল আমজাদের। আরো কয়েকবার ডাকল! তারপর একটু সঙ্কোচের সঙ্গেই এ-ডি-সি সাহেবের কপালে হাত দিল আমজাদ। আপন মনেই বলে উঠল, সাব কা বুখার হুয়া।
দার্জিলিং কলকাতার ঠাণ্ডা গরমে এমন হতেই পারে। দুতিনদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যায় কিন্তু ক্যাপ্টেন সাহেবকে তো দুতিনদিন শুয়ে থাকলে চলবে না। অনেক ভি-আই-পিকে তার রিসিভ-সি-অফ করতে হবে। আমজাদ ভেবে-চিন্তে ডাক্তার সাহেবকে খবর দিল।