আমি নিরুপায় হয়ে অদৃষ্টের হাতে সব কিছু ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভাবতে পারিনি তোমার চোখের জল মোছাতে পারব, মনের শূন্যতা, হাহাকার দূর করতে পারব। বহুদিন বহু বছর ভাবতে পারিনি। কলকাতা এসেও না। কিন্তু
এতক্ষণ বেশ লিখছিল। এবার ক্যাপ্টেন একটু থামল। একটা সিগারেট ধরাল। দু-একবার টান দিল। একটু ভাবল, একটু হাসল।
একটু লজ্জা করল নাকি।
হয়তো হবে। মা-র কাছে আবার লজ্জা কিসের? তাছাড়া অমন মা কজনের হয়?
সিগারেটটা অর্ধেক না খেয়েই ফেলে দিল। আবার লিখতে শুরু করল।
…তোমার অব্যক্ত ইচ্ছায় যে আমার জীবনটা এমন মোড় ঘুরবে ভাবতে পারিনি। প্রথমে বেশ কিছুকাল দ্বিধা ছিল, সঙ্কোচ, সন্দেহ ছিল। দীর্ঘদিন ধরে আপন মনে বিচার করেছি। তবুও মনে হচ্ছে, না জীবনটা সত্যিই মোড় ঘুরছে, মনে হচ্ছে মণিকাকে নিয়ে নতুন জীবন সম্ভব হতে পারে।
মণিকার সম্পর্কে তোমাকে বেশি কিছু লিখব না। তুমি নিজে এসে দেখবে, বিচার করবে। আমার দৃষ্টি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেই তোমার দেখার শুরু হবে। আমার অদেখা, অজ্ঞাত তুমি দেখতে পারবে, জানতে পারবে।
কয়েকদিনের মধ্যেই গভর্নর দার্জিলিং যাচ্ছেন। আমিও ওর সঙ্গে যাব তবে দু একদিন পরেই ফিরব। কলকাতা দিয়ে অনেক ভি-আই-পি যাতায়াত করবেন এর মধ্যে। ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারি ও আরো দুএকজন হয়তো এক রাত্রি রাজভবনের থাকতেও পারেন। সেজন্য আমাকে এখানে থাকতে হবে। তুমি ওই সময় এসো। মণিকাঁদের ওখানেই তোমার থাকার ব্যবস্থা করব। ওর বাবা ডক্টর ব্যানার্জি ও মিসেস ব্যানার্জি নিশ্চয়ই খুশি হবেন।
একটা কথা তোমাকে জানিয়ে রাখি। মনে মনে দুজনেই অনেকটা এগিয়েছি। তবুও আমি কোনো পাকা কথা দিইনি, দিতে পারিনি। আর কাউকে না হোক মণিকাকেই তো সব কথাই বলতে হবে। আমার পক্ষে সেসব কথা বলা অসম্ভব। কোনোদিন কাউকে আমি ওই কাহিনি বলতে পারব না। সব কিছু শুনেও যদি ও রাজি হয় তাহলে ডক্টর ব্যানার্জি ও তার স্ত্রীকে বলা ভালো হবে।
মণিকা জানতে পারল না এই চিঠির কথা। ক্যাপ্টেন কিছু বলল না। দার্জিলিং যাবার আগের দিন সন্ধ্যায় অনেকক্ষণ কাটিয়েছিল ওদের ওখানে। খাওয়া-দাওয়ার আগে ঘণ্টা খানেকের জন্য দুজনে একটু ঘুরতেও গিয়েছিল।
গাড়িতে স্টার্ট দিয়েই ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাবে?
যেখানে খুশি।
কোথায় গেলে তুমি খুশি হবে?
আমাকে খুশি করার জন্য তোমার এত চিন্তা?
ক্যাপ্টেন সেকেন্ড গিয়ার দিয়ে একটু হাসতে হাসতে জানতে চাইল, তোমাকে খুশি করার জন্য আমার একটুও চিন্তা নেই?
মণিকাও হাসল। অভিমান-মেশা সামান্য বিদ্রুপের হাসি। আমাকে সুখী করা ছাড়া তোমার আর কি চিন্তা?
ক্যাপ্টেনের কাছে মণিকার অনেক আশা, অনেক দাবি। সে আশা, সে দাবি মেটাতে পারছে ক্যাপ্টেন। মণিকা যেন আর সহ্য করতে পারে না। অভিমান তো হবেই। হয়তো দুঃখও। লুকিয়ে লুকিয়ে দুফোঁটা চোখের জলও পড়তে পারে। মণিকার কথায় ইঙ্গিত পায় ক্যাপ্টেন।
থার্ড গিয়ার দিয়েই স্পীড দেয় না ক্যাপ্টেন। এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে আরেক হাতে একটা সিগারেট বের করে দুটি ঠোঁটের মাঝে নেয়। নিউ আলিপুর ছাড়িয়ে বড় রাস্তা এসে গেছে। মিন্টটা একটু দূরেই। ক্যাপ্টেন দুএকবার চাইল মণিকার দিকে।
খুব রাগ করেছ?
কার ওপর রাগ করব?
তোমার এই ড্রাইভারের ওপর।
তোমার ওপর রাগ করবার কি অধিকার আমার?
সে প্রশ্নের জবাব পরে দেব! আগে স্বীকার কর রাগ করেছ।
বিন্দুমাত্রও না।
তবে যে লাইটারটা জ্বেলে ধরছ না?
মণিকা সত্যি এবার লজ্জা পায়। প্রফেসর মঙ চুরুট মুখে দিলেই ও লাইটার জালত। বেশ লাগত। ডক্টর ব্যানার্জির ওসব নেশাফেশা নেই, মণিকার লাইটার জ্বালার নেশাটাও বন্ধ ছিল। কিন্তু ক্যাপ্টেনকে কাছে পাবার পর থেকেই আবার শুরু করেছিল। ক্যাপ্টেন সিগারেট তুলতে না তুলতেই মণিকা লাইটার জ্বেলে ধরত। অভিমানী মন খেয়াল করেনি ক্যাপ্টেনের মুখে সিগারেট। অভিমানী হলেও সে তো ওকে অবজ্ঞা করতে চায়নি।
মণিকা সঙ্গে সঙ্গে ত্রুটি স্বীকার করল, সরি, ক্ষমা কোরো।
সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে মণিকার মুখের পর ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ফাইনাল বিচারের রাত্রি সমাগতপ্রায়। তখনই তোমার বিচার হবে।
ঠিক বুঝতে পারে না মণিকা। তার মানে।
একটু ধৈর্য ধর।
বেহালা-ঠাকুরপুকুর পার হয়ে চলে গিয়েছিল ওরা। ড্যাসবোর্ডের আবছা আলোয় মণিকাকে বারবার দেখছিল ক্যাপ্টেন। লুকিয়ে লুকিয়ে আড়চোখে।
হঠাৎ ধরা পড়ে মণিকার কাছে। অমন করে বারবার কি দেখছ?
তোমাকে?
আমাকে কোনোদিন দেখনি?
নিশ্চয়ই দেখেছি।
তবে আবার অমন করে দেখছ কেন?
দেখছি তুমি আরো কত সুন্দর হয়েছ।
ঠাট্টা করছ?
ঠাট্টা করব কেন?
না, না। আর পারে না ক্যাপ্টেন। বাঁ হাতটা দিয়ে মণিকার একটা হাত চেপে ধরে। একটু চাপ দেয়। একবার তুলে নিয়ে নিজের মুখের পর দিয়ে বুলিয়ে নেয়। আর্মি অফিসারের পোশাক পরেও ক্যাপ্টেনের মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। একটু যেন অসংযত হয় মন।
তুমি জানো না মণিমালা, তুমি আমার কি উপকার করেছ…
মণিকা অবাক না হয়ে পারে না, মণিমালা? মণিমালা কে?
বলতে চায়নি, হঠাৎ মুখ থেকে ফসকে বেরিয়ে গেছে।
কে আবার? তুমি।
কই কোনোদিন তো মণিমালা বলে ডাকতে শুনিনি।
ভেবেছিলাম তোমার-আমার জীবনের সব চাইতে স্মরণীয় রাত্রিতে তোমার নতুন নামকরণ করব।