আগে?
ইউনিফর্ম চাপিয়েই ক্যাপ্টেন খুশি থাকতো। কসমেটিক্স তো দূরের কথা, মাসের পর মাস। আফনার সেভ লোশন পর্যন্ত কিনতে ভুলে যেত।
মনের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে, জীবনের প্রতি মুহূর্তের আশা-ভরসা, আনন্দ-বেদনার সঙ্গে ক্যাপ্টেন আজ অনুভব করে মণিকাকে। মণিমালাকে?
মণিমালা?
হ্যাঁ, মণিমালা। ক্যাপ্টেনের খুব বেশি অভিব্যক্তি নেই কিন্তু তাই বলে তার স্বপ্ন নেই? যেদিন মণিকাকে ও কাছে পাবে, নিজের করে পাবে, ফুলের জলসায় নীরব কবির মতো সলজ্জভাবে আসন্ন সম্ভাবনাপূর্ণ মুহূর্তের জন্য প্রতিক্ষা করবে, সেদিন থেকে ক্যাপ্টেন তো ওকে মণিমালা বলেই ডাকবে।
.
ক্যাপ্টেন জানে মণিকার কথা মাকে জানালে তিনি খুশি হবেন। নিশ্চিত হবেন। খুশি হবেন এই কথা ভেবে যে তার একমাত্র পুত্র সুস্থ স্বাভাবিক হয়েছে। নিশ্চিন্ত হবার কারণও অনেক। এক মুহূর্তে একটা বুলেটের গুলিতে যে সুখের সংসারটা ছারখার হয়ে গিয়েছিল কবছর আগে, সে সংসার হয়তো সুখের, শান্তির হবে। এই কবছরের অস্বাভাবিক চাপা উত্তেজনাটা বিদায় নেবে। নিশ্চিন্ত হবেন না?
তাছাড়া একমাত্র ছেলে আর্মিতে, তাতেই মার ঘুম নেই। মার ধারণা যেখানেই যুদ্ধ-বিগ্রহ বা মারামারি কাটাকাটি হোক, তার ছেলেকেই সব কিছু সামলাতে হবে। আর দিন-রাত্রির অত-শত বিপদের মধ্যে থাকলে কখন কি হয় বলা যায়? একে অমন চাকরি তার উপর সংসারধর্ম করল না। করতে পারল না। চিন্তার শেষ নেই মার।
মণিকার কথা জানলেই হল। হয়তো পরের ট্রেনেই ছুটে আসবেন। কিছু বলা যায় না। মণিকাকে দেখলে মার-র মাথার ঠিক থাকবে কিনা, তাই বা কে জানে? হয়তো মণিকারই হাত দুটো ধরে কাঁদতে কাঁদতে ভিক্ষা চাইবেন তার ছেলেকে বাঁচাবার জন্য। আরো কত কি করবেন, কে বলতে পারে?
তাছাড়া কিছু না জানিয়েও যদি মণিকার সঙ্গে মার আলাপ করিয়ে দেওয়া যায় তাহলেও হয়তো মা প্রস্তাব না করে পারবেন না। অমন শান্ত-স্নিগ্ধ অথচ সুন্দরী মেয়েকে দেখলেই মার পছন্দ হবেই। আর পছন্দ হলে নিশ্চয়ই…
গান শুনলে? মণিকা যদি আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব শোনায়? মা সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, শেষের লাইনটা আর একবার কর না মা। বড় ভালো লাগে ওই কটি কথা! এই বলে হয়তো নিজের মনে মনেই আবৃত্তি করবেন–
আমার শুধু একটি মুঠি ভরি
দিতেছ দান দিবস-বিভাবরী–
হল না সারা, কত না যুগ ধরি
কেবলই আসি লব।
.
ক্যাপ্টেন অনেকবার ভেবেছে মাকে সব কিছু জানাবে, কিচ্ছু লুকোবে না। দুএকবার চিঠি লেখার কাগজপত্র নিয়েও বসেছিল। শেষ পর্যন্ত লেখেনি। লিখতে পারেনি। নিজেকে বিচার করতে চেয়েছিল ভালোভাবে। বিচার করতে চেয়েছিল, কোনো মোহের ঘোরে ও মণিকাকে চাইছে না তো? একটু মোহ আছে বৈকি। হাজার হোক মণিকাকে দেখে, আলাপ করে, এত নিবিড় ভাবে মেলামেশা করে নিশ্চয়ই কিছুটা মোহ জন্মেছে কিন্তু শুধুই মোহ নয় তো? আপন মনে বিচার করতে গিয়ে ক্যাপ্টেন চিঠিপত্র লেখার কাগজপত্তর সরিয়ে রেখেছে। নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। আরো ভালোভাবে নিজের মনকে, নিজের সত্তাকে বিচার করতে চেয়েছে। পরীক্ষা করতে চেয়েছে মণিকার প্রতি তার ভালোবাসা।
হয়তো মণিকাকেও পরীক্ষা করতে চেয়েছে। আর্মি অফিসারদের প্রতি কিছু মেয়ের মোহ থাকে, আকর্ষণ থাকে। দুর্বলতাও থাকতে পারে। দুনিয়ার সবার থেকে নিজেকে একটু স্বতন্ত্রভাবে দেখার লোভ কোনো মেয়েই সামলাতে পারে না। সর্বত্র, সব পরিবেশেই। কুলি-মজুর, কেরানী-অফিসার, বীমার দালাল, বিজনেসম্যান যাকেই বিয়ে করুক না কেন, বিয়ের পর মেয়েরা অনন্যা হয়ে ওঠে। গভর্নরের এ-ডি-সি-কে বিয়ে করে সে হয়তো সেই আত্মতৃপ্তি একটু বেশি করে উপলব্ধি করার প্রয়াস পারে। এ-ডি-সি-র প্রতি আকর্ষণ হবার আরো অনেক কারণ আছে। যুক্তিতর্কে সে কারণ না টিকলেও আছে। থাকে। ক্যাপ্টেন তা জানে। বুঝতে পারে। মণিকাও সেই মরীচিৎকার মোহে এগিয়ে আসেনি তো? যৌবনের মোহনায় দাঁড়িয়ে জোয়ারের টানে কিছু দূর ভেসে যেতে চায়নি তো? উত্তাল উন্মত্ত যৌবনের মোহনা থেকে দূরে এসে ভাটার টানেও মণিকা ভালোবাসবে তো? নিজের মনপ্রাণ সত্তা দিয়ে ক্যাপ্টেনের কল্যাণ চাইবে তো?
ক্যাপ্টেন এখন নিশ্চিন্ত। মণিকাকে নিয়ে মনের দ্বন্দ্ব, শঙ্কা ভালোভাসার পলিমাটির তলায় বহুদিন আগেই চাপা পড়েছে। ওকে না পাবার জন্য মণিকার মনে অব্যক্ত ব্যথা, শূন্যতা ক্যাপ্টেন বুঝতে পারে, অনুভব করতে পারে। বেশ লাগে। এতকাল তো ওর জন্য কেউ এমন শূন্যতা অনুভব করেনি। ভালো লাগবে না?
ক্যাপ্টেন নিজেও তো ওই একই ব্যথা বেদনা শুন্যতা অনুভব করছিল। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে। রাজভবনের আকর্ষণ, সোসাইটির গ্ল্যামার, লাঞ্চ-ডিনার-ককটেলের হার্সিঠাট্টাতেও নিজেকে ভরিয়ে তুলতে পারছিল না। বড় বেশি অপূর্ণ, অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছিল। সবকিছু পেয়েও যেন ওর অভাব মিটছিল না। কিছুতেই না।
অ্যাডভান্স পার্টি চলে যাবার পর কয়েকটা দিন অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। তারপর যখনই একটু সময় পেল, কাগজপত্র নিয়ে বসল মাকে চিঠি লিখতে। আর দেরি করতে পারল না, চাইল না। মার জ্বর হলে, সদ্যজাত শিশুরও জ্বর হয়, সর্দি লাগে। আজ আমি বড় হয়েছি। তোমার জ্বর হলে সর্দি লাগলে আমার হয় না। হতে পারে না। তোমার দুধ খেয়ে, কোলে চড়ে আমি বড় হয়েছি। আর ধীরে ধীরে জন্ম নিয়েছে আমার স্বতন্ত্র সত্তা। জন্ম নিয়েছি আবার আমি। দূরের মানুষের কাছে আমি একটা স্বয়ং সম্পূর্ণ মানুষ। একটা পরিপূর্ণ সত্তা। কিন্তু তা কি হয়? সে কি সম্ভব। আজ আমার মুখে হাসি না দেখলে তোমার মুখে হাসি ফুটবে না, আমার দুঃখে তোমার চোখের জলের বন্যা বইবে। আমার মনের শূন্যতায় তোমার মনপ্রাণ হাহাকার করে। এসব তো আমি জানি। তাইতো তোমার মুখোমুখি হতে আমার এত ভয়, এত দ্বিধা।