তারপর গত দশ বছরে কত শত অনুষ্ঠানে কত শতবার দেখা হয়েছে দিবানাথ ও সতীনাথ সরকারের সঙ্গে। শুধু দেখা সাক্ষাৎ আলাপ-পরিচয় নয় সতীনাথের সঙ্গে আজ তাঁর গভীর
এই সতীনাথই দিয়েছিল লাইটারটা। রনসনের বেস্ট কোয়ালিটি। আঙুল দেবার আগেই যেন জ্বলে ওঠে। সে আগুন বাড়ান যায়, কমান যায়। কখনো দপ করে জ্বলে, কখনও ধীরে ধীরে জ্বলে। দিনের আলোয় সে আগুনের শিখা নজরে পড়ে না অপরিচিতের চোখে।
লাইটারটা নিয়ে আরো একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার পর ক্যাপ্টেন রায় সিগারেট ধরালেন। এক গাল ধোঁয়া ছাড়লেন।
আবার নজর পড়ল লাইটারটার উপর। আপন মনেই মুচকি হাসল। এতো লাইটার নয়, যেন সতীনাথ সরকারের জীবন্ত প্রতিমূর্তি। চক্ চল্ ঝক ঝক করছে উপরটা। দেখে বুঝা যায় না, একটা আগ্নেয়গিরি। কল্পনা করা যায় না, এর ভেতর এত আগুন লুকিয়ে আছে। রনসন লাইটারের মতো সে আগুন দিনের আলোয় মিশে যায় কিন্তু সন্ধ্যার পর ফ্রি স্কুল স্ট্রিট আর পার্ক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটগুলোতে আলো জ্বলে উঠলে…
হঠাৎ ঘড়ির দিকে নজর পড়তেই সতীনাথের চিন্তা কোথায় লুকিয়ে পড়ল। এনগেজমেন্ট ডায়েরির দিকে তাকাতে না তাকাতেই টেলিফোন বেজে উঠল।
এ-ডি-সি হিয়ার।
মুহূর্তের জন্য ওপাশ থেকে কি যেন শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, সেন্ড হিম আপ।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন রায়। টেবিলের ওপাশ থেকে টুপিটা নিয়ে মাথায় দিলেন। ইউনিফর্মটা একটু টেনে টুনে ঠিক করে আর এক ঝলক ঘড়িটা দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
বেয়ারা টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
ক্যাপ্টেন রায় বললেন, নেক্সট ভিজিটার্স আসছেন।
রাজভবনের বেয়ারা চাপরাশীদের একটু ইঙ্গিত করলেই কাজ হয়। তাছাড়া এরা এদের কাজকর্ম দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সরকারি দপ্তরখানায় আই-সি-এস সেক্রেটারিরা ঘন্টা বাজিয়ে বাজিয়ে হাঁপিয়ে যান কিন্তু বেয়ারাদের দর্শন পান না। যে হেড অ্যাসিসট্যান্ট সেক্সন অফিসারদের ভয়ে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়, সেই তাদের টেবিলের ঘণ্টাটা দেখবেন। ঠং ঠং করে বাজাতে বাজাতে ঘণ্টার মাথাগুলো বেঁকে তুবড়ে গেছে, হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বেয়ারা-চাপরাশীর দল নির্বিকার। একটু চেঁচামেচি হয়তো শুনতে হয়, তবে বেয়ারা-চাপরাশীর দল ওসব গ্রাহ্যই করে না।
রাজভবন সরকারি পয়সায় চললেও অনেকটা বড় বড় হোটেলের মতো। ইসারা-ইঙ্গিত ফিসফিসই বেশি।
রাজভবনকে হোটেল বললেও অন্যায় হবে না। ভি-আই-পির দল তো এখানেই আতিথ্য গ্রহণ করেন। কখনও স্বদেশি, কখনও বিদেশি। কেউ একদিন বা কেউ এক সপ্তাহের জন্য। পার্থক্য শুধু একটাই। ক্যাশিয়ার-একাউন্টেন্টের কাউন্টার এখানে নেই। আর নেই আগমন নির্গমনের সময় ওই বিরাট লম্বা খাতায় দস্তখতের পর্ব। ছোটখাটো পার্থক্য আরো আছে।
বেয়ারাকে ভিজিটার আসার কথা বলেই ক্যাপ্টেন রায় এগিয়ে গিয়ে গভর্নরের ড্রইংরুমের দরজায় দু-একবার নক করেই ভেতরে গেলেন।
গভর্নর এ-ডি-সি-কে দেখেই বুঝলেন, পরবর্তী দর্শনার্থী হাজির।
মিঃ জগতিয়ানী গভর্নর সাহেবের দুহাত ধরে বিদায় নিয়ে ক্যাপ্টেন রায়ের সঙ্গে বেরিয়ে এলেন।
করিডোরে এসে দুজনে হ্যাঁন্ডসেক করলেন।
ক্যাপ্টেন রায় বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করে বেশ লাগল।
ওসব ফর্মালিটি ছেড়ে দিন। একদিন সন্ধ্যাবেলায় চলে আসুন আমার ভবানীপুরের বাড়িতে। তেলেভাজা মুড়ি খেতে খেতে আড্ডা দেওয়া যাবে আর আমার মেয়ের গান শুনে আসবেন।
সিঁড়ির দিকে এগুতে এগুতে ক্যাপ্টেন রায় জিজ্ঞাসা করলেন, কি গান?
হিন্দী ফিল্মের গান না, পিওর বাংলা গান।
আচ্ছা।
আচ্ছা-টাচ্ছা নয়, একদিন আসুন।
সিঁড়িতে পা দিয়ে মিঃ জগতিয়ানী পিছন ফিরে তাকিয়ে বললেন, ভয় নেই, আমি ব্যবসাদার হলেও আপনাকে এক্সপ্লয়েট করব না।
না, না, ও কি বলছেন।
মিঃ জগতিয়ানী বিদায় নিলেন। ক্যাপ্টেন রায় অফিসে আসতে না আসতেই পরবর্তী দর্শনার্থী মিস্টার আর কে চ্যাটার্জি এলেন।
ক্যাপ্টেন রায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, গুডমর্নিং স্যার।
গুডমর্নিং।
আবার বেয়ারার তলব। ছাপান স্লিপ গেল হিজ এসেলেন্সির কাছে। বেয়ারা ঘুরে এল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।
ক্যাপ্টেন রায় উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় টুপিটা দিয়ে এক পা এগিয়ে বললেন, ইয়েস স্যার, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড…
আবার ড্রয়িংরুমের দরজায় দুবার নক করে ক্যাপ্টেন রায় ভিতরে গিয়ে বললেন, ইওর এসেলেন্সি! মিঃ আর কে চ্যাটার্জি ইজ হিয়ার।
মিঃ চ্যাটার্জিকে এগিয়ে দিয়ে এ-ডি-সি পিছিয়ে এলেন। মাথাটা একটু নীচু করে বিদায় নিলেন গভর্নরের কাছ থেকে।
এ-ডি-সি সাহেব বেরুতে না বেরুতে বেয়ারা ট্রে-তে করে চা-স্ন্যাকস্ নিয়ে ঢুকল।
ক্যাপ্টেন রায় নিজের ঘরে ফিরে এসে টুপিটি খুলে চেয়ারে বসে আবার একটা সিগারেট খাবার জন্য সিগারেট কেস আর লাইটারটা তুলে নিলেন। একটু অন্যমনস্কভাবে লাইটারটা জ্বালাতে গিয়ে হঠাৎ দপ করে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। চারপাশে দরজা-জানলা খোলা। সূর্যের আলোয় ভরে আছে সারা ঘর। তবুও এমন বিশ্রীভাবে লাইটারটা জ্বলে উঠল যে চোখ দুটো যেন সহ্য করতে পারল না।
ক্যাপ্টেন রায়ের মনে পড়ল। হ্যাঁ, এই দিনের বেলাতেও সতীনাথ সরকার কখনও কখনও জ্বলে ওঠে। দপ করে জ্বলে ওঠে, দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ক্যাপ্টেন রায়ের মতো বন্ধুদের চোখগুলো সহ্য করতে পারে না।