মণিকাকে কি সব কথা বলা যায়? সারাদিন সবার সঙ্গে ওকে হাসতে হয়, কিন্তু…কিন্তু কি?
ক্যাপ্টেন মণিকার কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ে। উৎকণ্ঠাভরা আরো একটা দিনের শেষ হয়।
দিন ফুরিয়ে যায় কিন্তু উৎকণ্ঠা? চিন্তা? ব্যথা-বেদনা, হতাশা? সব লুকিয়ে থাকে। চাপা থাকে।
সব কিছু চাপা দেবার জন্যই তো এলাহাবাদ ছেড়ে পালিয়েছিল। ভেবেছিল দৈনন্দিন জীবনেরা উত্তেজনায় ভুলতে পারবে সেই অবিস্মরণীয় নাতিদীর্ঘ ইতিহাস। ভেবেছিল মত্ত-প্রমত্ত থাকবে। দিনের বেলায় কাজের নেশায়, রাত্রে অফিসার্স ক্লাবে, বারে। বোতল বোতল হুইস্কি গলা দিয়ে ঢেলে মুছে ফেলবে সব স্মৃতি।
পারেনি। বহু চেষ্টা করেও পারেনি। প্রথম প্রথম অনেক দূর এগিয়েছিল। পরে ফিরে এসেছে। ও পথ ছেড়ে দিয়েছে। পুরনো বন্ধুরা তো ক্যাপ্টেন রায়কে দেখে অবাক হয়। চব্বিশ ঘণ্টা সিগারেট খাবে কিন্তু কোনো অকেশন না হলে এক পেগও খাবে না।
কি করে ক্যাপ্টেন হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মা ওর দুটি হাত ধরে অনুরোধ করেছিলেন?
অনুরোধ?
না, না। ওকে কি অনুবোধ বলে? দুই হাত ধরে ভিক্ষা চেয়েছিলেন মা। জননী। গর্ভধারিণী। চির কল্যাণী, চির শুভাকাক্ষিনী।
তুই নিজেকে যদি অমন শেষ করে দিস তাহলে আমি কি নিয়ে বাঁচব বল তো?
প্রয়াগ সঙ্গমের ধারে হনুমানজীর মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে মা-র পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল ক্যাপ্টেন। পরে মনে মনে বলেছিল, আমার জন্য আর ওই হতভাগিনীকে চোখের জল ফেলতে হবে না। না। কোনোদিন না। এই পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আর কে আমার জন্য এমন করে…
রাত্রে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও মনে পড়ছিল সেই সর্বনাশা দিনগুলোর কথা। স্মৃতি। বেদনা।
মাঝে মাঝে অসতর্ক মুহূর্তে মনটা আরও পিছিয়ে যেতে চায়। ভয়ে আঁতকে ওঠে। পারে না। রাগে, দুঃখে, ঘেন্নায় সারা শরীরটা জ্বলতে থাকে। একটা অব্যক্ত বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বহুঁকাল ভুলে ছিলেন। নিজের কথা চিন্তাই করতেন না ক্যাপ্টেন। দিনরাত্রির লীলাখেলার মধ্য দিয়ে শ্লথ পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছিলেন অনাগত ভবিষ্যতের দিকে। সে ভবিষ্যতের কাছে কোনো প্রত্যাশা ছিল না ওর, কেন দাবি ছিল না, দিনের আলোয় কোনো স্বপ্ন জন্ম নিত না, রাত্রের অন্ধকারে কোনো স্বপ্ন মিলিয়েও যেত না।
বেশ ছিলেন ক্যাপ্টেন। কলকাতায় এসেও বেশ ছিলেন। আমজাদ রমজানের কাছে গল্প শুনে বেশ কাটছিল দিনগুলো। কোনো শূন্যতা অনুভব করতেন না। রাত্রে ঘুম ভেঙে যেত কোনো দিন। বৈভব তীর্থ গভর্নমেন্ট হাউসে থেকেও বেশ নিরাসক্ত ছিলেন ক্যাপ্টেন রায়।
প্রলোভন যে আসেনি, তা নয়। এসেছে। কখনও মিস গুপ্তা বা মিসেস রায়চৌধুরির কাছ থেকে, কখনও আবার কোনো অতিথিনীর কাছ থেকে। আরো কত জায়গা থেকে। মুচকি হেসে পাশ কাটিয়ে গেছেন ক্যাপ্টেন। মনে কোনোদিন আলোড়ন আসেনি। উত্তাপ বোধ করেছেন মনে মনে কদাচিৎ।
কিন্তু হঠাৎ সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। প্রথমে মনে হয়েছিল।
A gentle shock of mind surprise.
Has Carried far into his heart the voice
Of mountain torrents.
একটু পরে আবার সহেন্দহ দেখা দিয়েছিল। তবে কি—
Two lovely black eyes,
Oh, what a surprise!
Only for telling a man he was wrong,
Two lovely black eyes!
ওয়ার্ডওয়ার্থ ঠিক, নাকি চার্লস কোবর্ণ? বিচার করতে পারেনি ক্যাপ্টেন। সার্জেন যেমন সবার অপারেশন করতে পারেন কিন্তু নিজের স্ত্রী? ছেলেমেয়ের? পারেন না। কেন ডাক্তাররা? নিজের চিকিৎসা কখনও করেন না, করতে পারেন না। ক্যাপ্টেনও পারেননি। কে ঠিক? কোনটা ঠিক?
তিনি শুধু জানলেন অজ্ঞাতসারেই নিজের হাতেই গাড়ির স্টিয়ারিংটা ঘুরে গেল। কেন, কেমন করে? জানেন না। জানবার প্রয়োজন বোধ করেননি। বহুদিন জানতে চান কি। কি প্রয়োজন? কি সার্থকতা? জীবনের সব প্রশ্নের কি উত্তর পাওয়া যায়? কেউ পায়নি, কেউ পাবে না। যৌবনেই জীবনের এই মর্মকথা জেনে গেছেন ক্যাপ্টেন। নিজের জীবন নিয়ে মর্মে মর্মে সে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন যে!
মণিকা অভিমান করেছে। হয়তো রাগও। কিন্তু ক্যাপ্টেন কি করে বোঝাবেন সব কথা? রেসের ঘোড়ার মতো দৌড়তে চাইলেই কি তা সম্ভব? বিধাতা-পুরুষ ক্যাপ্টেনের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন। তিনি তো চাননি কারুর জীবন নিয়ে খেলা করতে। মণিকাকে নিয়েও নয়। কখনই নয়। যে সম্মান, ভালোবাসা, ঐশ্বর্য মণিকা ওকে দিয়েছে, তা নিয়ে কি খেলা করা। যায়? আর কেউ পারলেও ক্যাপ্টেনের সে ক্ষমতা নেই, ইচ্ছাও নেই।
মণিকা নিশ্চয়ই একটু আহত মন নিয়ে ফিরে গেছে কিন্তু তিনি তো চাননি ওর ভালোবাসার অমর্যাদা করতে, চাননি ওকে আহত করতে। সেকথা বোঝাবেন কেমন করে। বরং ক্যাপ্টেন স্বপ্ন দেখেন মণিকাকে সসম্মানে ওর জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে।
তাছাড়া মণিকার কাছে ক্যাপ্টেন কৃতজ্ঞ। অশেষ কৃতজ্ঞ। বহুদিন ধরে মহাশূন্যে বিচরণ করার পর মণিকাই ওকে ফিরিয়ে এনেছে এই পৃথিবীতে। প্রেম, ভালোরাসা, স্নেহ, মায়া-মমতার রাজ্যে। দেহ ছিল কিন্তু তার চাইতে বেশি ছিল দাহ। মণিকাই মুক্তি দিয়েছে সে দাহ থেকে, সে অব্যক্ত অসহ্য বেদনা থেকে।
আরও অনেক কিছু দিয়েছে মণিকা। মানুষকে আর পৃথিবীতে নতুন করে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। ক্যাপ্টেন তো নিজেকেও ভালোবাসতে ভুলে গিয়েছিল। আজ সে নিজেকে ভালোবাসে। সকালবেলায় তাইতো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাক ব্রাশ করতে করতে গান গায়, এ মণিহার আমায় নাহি সাজে…