মাউন্ট এভারেস্ট হোটেলের ডাইনিং হলের এসব আলোচনা, জিমখানা ক্লাবের বিলিয়ার্ড রুমে পৌঁছতে দেরি লাগেনি। প্লান্টার্স খৈতান সাহেবদের বাগান কিনে সাহেব হবার চেষ্টা করছেন। তাছাড়া বাপ-দাদা কলকাতার স্টক-এক্সচেঞ্জ আর খিদিরপুরের তিন-চারটে কলকারখানা সামলাতে এত মত্ত যে জুনিয়র খৈতান নতুন বিজনেস সামলাতে এসে প্রমত্ত হবার অফুরন্ত সুযোগ পাচ্ছেন।
ক্যাপ্টেন রায় এইসব নোংরা প্রতিযোগিতার নেপথ্য কাহিনি সব জানে। প্রতিবছর এর পুনরাবৃত্তি হয়। এবার না হবার কোনো কারণ খুঁজে পায়নি ক্যপ্টেন। তাইতো অনুরোধ আসার আগেই সেক্রেটারি আর হিজ এক্সেলেন্সির সঙ্গে আলাপ করে নিল।
পরের দিন খবরের কাগজে গভর্নরের দার্জিলিং প্রোগ্রাম বেরুবার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল হাই সোসাইটির পাগলামি। লেটন্যান্ট ভাটিয়া চলে গেছে। নর্মাল এ-ডি-সি ইন ওয়েটিং-এর কাজ তো আছেই, তারপর সারাদিন এই ঝামেলা। দিনরাত্রি-চব্বিশ ঘণ্টা। তাছাড়া প্রায় রোজই একবার ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে দমদম যেতে হয় কোনো না কোনো গেস্টকে রিসিভ বা সি-অফ করতে। এরই ফাঁকে ফাঁকে অতিথিদের দেখাশুনাও করতে হয় ওকেই।
শান্তশিষ্ট ক্যাপ্টেনও যেন মেজাজ হারিয়ে ফেলে। অধিকাংশ গেস্টদের ডিপারচার হচ্ছে ভোরবেলায়। ছটা নাগাদ। পাঁচটায় উঠেই ক্যাপ্টেনকে তৈরি হতে হয় ওদের বিদায় জানাবার জন্য। তাছাড়া যেখানে বাগের ভয়, সেখানেই রাত হয়। সিঙ্গাপুরে সিয়াটো কনফারেন্সের জন্য ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারি, টার্কিশ ডিফেন্স মিনিস্টার, ইটালিয়ান ফরেন মিনিস্টার আর ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার অফ ইরান সিঙ্গাপুরের পথে দমদম হয়ে গেলেন। পরপর তিনদিন মাঝরাতের পর বা শেষ রাতের গভর্নরের পক্ষ থেকে ক্যাপ্টেনকে অভ্যর্থনা জানাতে হল। সারাদিন পরিশ্রমের পর রাতের ঘুমটুকু পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হল।
একদিন মাত্র মিনিট পনেরোর জন্য মণিকাঁদের ওখানে গিয়েছিল। তাছাড়া রোজ টেলিফোনে কথা বলবারও সুযোগ থাকে না। মণিকাও দুদিন রাজভবনে এসেছিল। দেখা হয়েছিল একদিন।
কেমন আছ?
খুব ভালো।
ঠোঁটের কোণায় সামান্য একটু হাসির রেখা ফুটিয়ে মণিকা বলল, তা আমি জানি। খবরের কাগজের ফ্রন্ট পেজে ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারির সঙ্গে ছবি বেরোচ্ছে, ভালো থাকবে না?
সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে ফেলে ক্যাপ্টেন ওপাশের কৌচটা ছেড়ে মণিকার পাশে এসে বসল। একবার হাসল, একবার চাইল। আলতো করে আঙুল দিয়ে মণিকার আধোবদন তুলে ধরল।
দারুণ রাগ করেছ, তাই না?
মণিকা জবাব দিল না। মুখাট আবার নিচে করল।
ক্যাপ্টেন একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করল, আরতি চলে গেছে?
হ্যাঁ।
আবার একটু নিস্তব্ধতা।
আচ্ছা আরতি বোধহয় ঠিক হ্যাপি নয়, তাই না?
সঙ্গে সঙ্গে মণিকা জবাব দেয়, হু ইজ হ্যাপি?
ডান হাত দিয়ে মণিকাকে কাছে টেনে নিয়ে মুখোনা তুলে ধরে বলে, তুমি তো সুখী।
ঘোড়ার ডিম।
ঘোড়ার ডিম? বলো কি?
মণিকা কি জবাব দেবে? চুপ করে থাকে।
ক্যাপ্টেন আবার বলে, সেদিন রাত্রের পরও তুমি কি একথা বলছ?
বলব না? সেদিন রাত্রের পর তুমি আমাকে উপেক্ষা করে চলেছ, আমি সুখী হব না?
একটু আদর-টাদর করে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ক্যাপ্টেন সেদিন নিজে গিয়ে ছেড়ে এসেছিল মণিকাকে।
রাজভবনে ফিরে এসে চুপচাপ বসে বসে ভাবছিল মণিকার কথা! অনেকক্ষণ, অনেক কিছু। ধীরে ধীরে কত কাছে এসে, কত নিবিড় হয়েছে। কত গম্ভীর হয়েছে, দুটি প্রাণের বন্ধন। প্রথম দিনের প্রথম অধ্যায়ের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন-সাধনা আজ পূর্ণ। তবুও কেন এই অপূর্ণতার বিস্বাদ? মণিকা কেন এখনও বিবর্ণ? পূর্ণ হয়েও পরিপূর্ণ হয় না কেউ। কেন?
সেন্টার টেবিলে পা দুটো তুলে দিয়ে কৌচে প্রায় শুয়ে পড়ে ক্যাপ্টেন। সিগারেট খেতে খেতে দৃষ্টিটা ঘুরে যায় বাইরের দিকে রাজভবনের চারপাশের শ্যামল সীমান্তে। মাটির তলায় লুকিয়ে থাকে বীজ। অঙ্কুরিত হবার সাধনায় সে উন্মাদ হয়ে ওঠে। একদিন সে সাধনার শেষ হয়। ধরিত্রী বিদীর্ণ করে সে বীজ আত্মপ্রকাশ করে, সূর্যের আলো দেখে সে খুশিতে ঝলমল করে ওঠে কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সে আবার পাগল হয়ে ওঠে। সুর্যের হাসি দেখার পর পরই সদ্য অঙ্কুরিত বীজ চারপাশে দেখে বিরাট বনানী। ওরা সবাই আকাশের কোলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে দশ দিকে নিজেকে বিস্তারিত করেছে। প্রচার করেছে নিজের সাফল্য, কৃতিত্ব, অস্তিত্ব। ওই বিরাট বনানীর মতো নিজের কৃতিত্ব প্রচারের জন্য সদ্যজাত শিশু-মহীরূহ আবার নতুন নেশায় মেতে ওঠে। ধাপে ধাপে এগিয়ে চলে আশা-নিরাশা। আকাশের কোলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে শান্তি পায় না ওরা। ফুলে ফলে নিজেকে সাজাতে চায়। চায় আরো কত কি!
প্রকৃতির কি বিচিত্র খেয়াল? গাছপালা পশুপক্ষী মানুষ–সবাই এক সুরে, এক ছন্দে বাঁধা। কেউ থামতে চায় না।
মণিকাও না। এক স্বপ্নের পরিণতিতে জন্ম নিয়েছে নতুন স্বপ্ন, নতুন আশা। নতুন প্রত্যাশা। হয়তো নতুন দাবিও। সে কি অন্যায়?
অন্যায় কেন হবে? তবে এত ব্যস্ততা কেন। এত হতাশ হবার কি আছে?
আপন মনে ক্যাপ্টেন ভাবে। স্বপ্ন কি ওর নেই? মণিকাকে নিয়ে কত কি ভাবে, কত কি আশা করে! কত অপূর্ণ বাসনা চাপা দিয়ে রেখেছে হাসি মুখে। কর্তব্যের আড়ালে, সামাজিক পরিবেশের চাপে।